শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

জনসংযোগে সাখাওয়াত পাচ্ছেন বেগ, প্রতীক বরাদ্দের অপেক্ষায় আইভী

SONALISOMOY.COM
ডিসেম্বর ৩, ২০১৬
news-image

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনও আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু না হলেও সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থীরা চষে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন এলাকা। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পরিচিতি বেশি থাকায় তিনি যে এলাকাতেই যাচ্ছেন সেখানেই লোকজন আসছেন দল বেঁধে। অপরদিকে, অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান সাত খুনের ঘটনায় মিডিয়াতে ব্যাপক আলোচিত হলেও বিভিন্ন এলাকাতে গিয়ে তিনি গণসংযোগে কিছুটা বেগ পাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিই এর মূল কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত কয়েকদিনে আইভী ও সাখাওয়াতের প্রচারণায় উঠে এসেছে এসব চিত্র।

এদিকে দিন যতই গড়াচ্ছে ততই আইভী ও সাখাওয়াত শিবিরে ঐক্যের চেয়ে বরং বিরোধ বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন কোনও না কোনও ইস্যুতে তৈরি হচ্ছে ওই বিরোধ, যা দিন দিন প্রকট আকারে রূপ নিচ্ছে। তবে ৫ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পরেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ও পরিস্থিতি দৃশ্যমান হবে এমনটাই ভাবছেন উভয় প্রার্থীই।


অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান

নাসিক নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে শুরুতেই বেকায়দায় পড়ে দলটি। দলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য নেতা তৈমূর আলম খন্দকার গত নির্বাচনের কথা মনে রেখে এবার প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করায় নতুন প্রার্থীর খোঁজে নামে বিএনপি। স্থানীয় পর্যায়ের মধ্যমসারির বেশ কয়েকজন নেতা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ দেখালে শেষ পর্যন্ত দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকেই বিএনপির প্রার্থী হিসেবে বেছে নেন।

তবে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত হলেও স্থানীয় পর্যায়ে সাখাওয়াতের পক্ষে এখনও দলের নেতাদের নামতে দেখা যায়নি। এ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশানের কার্যালয়ে নারায়ণগঞ্জের নেতাদের বার বার ডাকলেও বিরোধের সুরাহা হচ্ছে না। আর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সাখাওয়াতের নির্বাচনি প্রচারণায়। গত ৬দিন ধরে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ চালালেও সঙ্গে দলীয় নেতারা না থাকায় প্রচারণায় বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। কারণ, এলাকার বেশিরভাগ মানুষ তাকে চেনেন না।

বৃহস্পতিবার সাখাওয়াত শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, কেন্দ্রীয় লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় গণসংযোগ করেন। এর আগে বুধবার শহরের নগর খানপুর, তল্লা এলাকাতেও গণসংযোগ চালান। সরেজমিনে তার প্রচারণা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এলাকার লোকজন একনামে তাকে চেনেন না। তাকে নিজের দলীয় পরিচয় এবং সাত খুনের ঘটনার উল্লেখ করে পরিচয় প্রকাশ করতে হচ্ছে। উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় বাদী পক্ষের আইনজীবী হিসেবে তিনি ব্যাপক আলোচিত হলেও মাঠের মানুষদের কাছে সে আলোচনার প্রভাব তেমন একটা না পড়ায় তাদের কাছে নিজেকে নতুন করে চেনাতে হচ্ছে তাকে।

সাখাওয়াতের ওই দু’দিনের গণসংযোগ পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়েছে, সাত খুনের ওই ঘটনায় আইনজীবী হিসেবে অনেকেই সাখাওয়াতের নাম শুনলেও তাকে আগে সামনাসামনি দেখেননি। তবে কেন্দ্রীয় লঞ্চ টার্মিনালে সাইফউদ্দিন নামের এক ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি সাখাওয়াতকে দেখে দূর থেকেই স্লোগান ধরেন, ‘সাত খুনের সাখাওয়াত’। আবার ওই স্থানেই প্রচারণার সময়ে কয়েকজন নারীকে দেখা গেছে তারা সাখাওয়াতকে ঠিকমতো চিনতে পারছেন না। তবে ধানের শীষের প্রতীকের কথা জানার পর চিনেছেন। ওই সময়ে খাদিজা আক্তার নামের একজন নারী বলে উঠেন ‘সাখাওয়াত চিনি না, ধানের শীষ চিনি’।

শহরের তল্লা এলাকাতে প্রচারণার সময়ে সাখাওয়াতের আলিঙ্গনে এসে শাহাদাত হোসেন নামের এক ব্যক্তি তাকে পরামর্শ দেন, ‘আপনাকে আরও পরিশ্রম করতে হবে, লোকজনদের চেনাতে হবে’।

সাখাওয়াতের সঙ্গে থাকা একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাখাওয়াতের সঙ্গে এখনও শীর্ষ কোনও নেতা না আসার কারণে তাকে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করতে হচ্ছে। সে কারণেই কোন এলাকাতে সাখাওয়াত হোসেন গেলেও তিনি নতুন হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন। অবশ্য ধানের শীষের প্রার্থী বলার পর আর কোনও সংকট থাকছে না।

ওই নেতা আরও জানান, মূলত নেতাদের মধ্যে বিরোধে রয়েই গেছে। কারণ, সবশেষ গত মঙ্গলবার খালেদা জিয়া নারায়ণগঞ্জের নেতাদের ডেকে নেন। তখন শহর বিএনপির সহ সভাপতি এম এ মজিদ, সহ সভাপতি জামালউদ্দিন কালু, বন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মুকুল বক্তব্যে খালেদা জিয়াকে জানান, ‘সাখাওয়াতের আদি নিবাস নারায়ণগঞ্জ নয়। এ শহরে তার নেই কোনও বন্ধু, নেই কোনও আত্মীয়। বরং বিদ্রোহী কমিটি করে তিনি অনেক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন। সে কারণেই তাকে মেনে নেওয়া বেশ কষ্টকর।’

পরে খালেদা জিয়া আপাতত সব অতীত ভুলে সাখাওয়াতের পক্ষে কাজ করতে নেতাদের নিদের্শনা দেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শহর বিএনপির সেক্রেটারি এটিএম কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শুক্রবার আমরা শহর বিএনপির জরুরি সভা ডেকেছি। আশা করছি, এদিন সব অভিমান ভুলে সবাই একসঙ্গে কাজ করবে।

সাখাওয়াত হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি তো এখনও প্রচারণা শুরু করি নাই। ৫ ডিসেম্বর থেকে প্রচারণা শুরু হবে। তখন সবাই নামবে। আমাদের মধ্যে কোনও বিরোধ নাই। আপাতত আমি বিভিন্ন এলাকাতে গিয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করছি।’

ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী

অনেক নাটকীয়তার পর আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক পাওয়া ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে এখনও প্রভাবশালী শামীম ওসমান ও তার লোকজনদের দৃশ্যমান বিরোধ কাটেনি। এর আগে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে শামীম ওসমান ও আইভীসহ স্থানীয় সিনিয়র নেতাদের ডেকে নিয়ে মিলেমিশে নৌকার পক্ষে কাজ করতে বলেন। পরে মিডিয়ার সামনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন নিয়ে আগ্রহের কথা জানালেও তাদেরকে দৃশ্যমান কোনও কাজে একত্রে দেখা যায়নি।

তবে এ ব্যাপারে শামীম ওসমান জানান, ‘আইভীকে আমি মোবাইলে তিনটি এসএমএস দিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে করণীয় কী জানতে চেয়েছি কিন্তু সে কোনও উত্তর দেয়নি। কিন্তু যেহেতু আমি নেত্রীর প্রতি আস্থা রাখি সেহেতু আমি নৌকার পক্ষেই কাজ করবো।’

এদিকে গত রবিবার কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আইভীর বৈঠকে শামীম ওসমানের বাবা প্রয়াত ভাষা সৈনিক একেএম সামসুজ্জোহা সম্পর্কে আপত্তিজনক বক্তব্য নিয়ে আবারও পুরানো বিরোধ প্রকট আকারে রূপ নিচ্ছে। যদিও আইভী বলেছেন, তিনি সামসুজ্জোহা সম্পর্কে কোনও ধরনের কটূক্তি করেননি। এটা অপপ্রচার করে কেউ কেউ পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছেন।

এ ব্যাপারে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি চন্দন শীল জানান, আমরা তো নেত্রীর সিদ্ধান্তে অবিচল। এত কিছুর পরেও আমরা নৌকার পক্ষে কাজ করবো বলে কথা দিয়েছি। কিন্তু আইভী সম্প্রতি দলমতের ঊর্ধ্বে থাকা স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক একেএম সামসুজ্জোহাকে নিয়ে যে কটূক্তি করেছেন তা বেদনাদায়ক, এটা অমার্জনীয়।

আইভীর সঙ্গে এখন পর্যন্ত জেলা যুবলীগ সভাপতি আবদুল কাদির, শহর কমিটির সেক্রেটারি আহমদ আলী রেজা উজ্জ্বলসহ ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া শীর্ষ নেতাদের দেখা যাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার দুপুরে আইভী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে এ কারণে এ মুহূর্তে অনেকেই আসছেন না। তবে ৫ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পরেই আমরা আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করবো। তখন সবাই আসবেন।’

দলের সবাই তার সঙ্গে আছেন দাবি করে আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী বলেন, ‘আমার সঙ্গে সবাই আছেন। আশা করি আওয়ামী লীগের সবাই একসঙ্গে কাজ করবেন। আমাদের মধ্যে কোনও বিভেদ নাই।’

এদিকে, রাজনৈতিক ঘোলাটে পরিস্থিতিতেও আইভী সম্প্রতি কয়েকটি এলাকায় গণসংযোগ করেছেন। সবশেষ তিনি মঙ্গলবার শহরের শহীদনগর ও ডিয়ারা এলাকায় গণসংযোগ করেন। ওই সময়ে দেখা গেছে, আইভী এলাকাতে এসেছেন এমন খবরে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ এসে ভিড় করছে। এক পর্যায়ে রীতিমতো মিছিলের মতো হয়ে যায় পরিস্থিতি। আচরণবিধি লঙ্ঘন হতে পারে ভেবে আইভী দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়েন।

মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, বিকেল পৌনে ৫টার দিকে আইভী শহীদনগর এলাকাতে আসার পরেই এলাকাতে রীতিমতো রব উঠে যায় ‘আইভী’ এসেছেন। তখন প্রচুর সংখ্যক নারীকে ঘর থেকে বের হয়ে আসতেও দেখা গেছে। এছাড়া বয়োজ্যেষ্ঠ লোকজনরাও আইভীর সঙ্গে দেখা করেন। তারা এলাকার উন্নয়নের জন্য অনেক কিছু প্রত্যাশা করেন। আইভীকে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিতে দেখা গেছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে আইভী যান সিটি করপোরেশনের চৌধুরীবাড়ি এলাকাতে। সেখানে তিনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় দিবসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। আইভী আসার খবরে সেখানে প্রচুর লোকজন জমায়েত হয়।

আগামী ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ভোট অনুষ্ঠিত হবে।

/টিএন/আপ-এমডিপি/