ডিলানকে ছাড়াই বিজয়ীদের হাতে উঠল নোবেল পুরস্কার
বব ডিলানকে ছাড়াই আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনে এ বছর নোবেল বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হলো পুরস্কারের পদক ও অর্থের চেক। শনিবার নরওয়ের রাজধানী অসলোতে শান্তিতে নোবেল জয়ী কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসের হাতে পুরস্কার তুলে দেয় নোবেল কমিটি।
আর চিকিৎসা বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, অর্থনীতি ও সাহিত্যে নোবেলজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হয় সুইডেনের স্টকহোমে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে। স্টকহোমের কনসার্ট হলে সুইডেনের রাজা কার্ল চতুর্দশ গুস্তাফ তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে পরিবেশনায় শিল্পীরা।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে সাহিত্যে নোবেলজয়ী রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান (বব ডিলান) সশরীরে পুরস্কার গ্রহণ করেননি বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রথমবারের মতো সাহিত্যে সর্বোচ্চ এই পুরস্কারজয়ী মার্কিন গায়ক ও গীতিকার ডিলান পুরস্কার নিতে স্টকহোমে আসবেন না বলে আগেই জানিয়েছিলেন।প্রত্যেক পুরস্কার বিজয়ীকে পদক ও সনদপত্রের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার।
এবছর নোবেল পুরস্কার জয়ী যারা
চিকিৎসা বিজ্ঞান: জীবদেহ কেমন করে ত্রুটিপূর্ণ কোষ ধ্বংস করে নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে, আর কোষ কীভাবে নিজের আবর্জনা প্রক্রিয়াজাত করে সুস্থ থকে, সেই রহস্যে আলো ফেলে নোবেল পুরস্কার জিতে নিয়েছেন জাপানের বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওশুমি।
চিকিৎসায় নোবেল জয়ী ইয়োশিনোরি ওশুমি
কোষ তার নিজের ভেতরের ক্ষতিগ্রস্ত প্রোটিন কণাকে যেভাবে সরিয়ে ফেলে, সে পদ্ধতিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অটোফাজি। আর যে জিনটি এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, সেটি শনাক্ত করেন টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ইয়োশিনোরি ওশুমি।পদার্থ বিজ্ঞান: তত্ত্বের মধ্য দিয়ে পদার্থের টপোলজিক্যাল দশার দিশা দেখিয়ে চলতি বছর পদার্থে নোবেল পেয়েছেন তিন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী। এরা হলেন ডেভিড জে ফাউলেস, এফ ডানকেন হোলডেইন ও জে মাইকেল হসট্রলিজ।
পদার্থে নোবেল জয়ী তিন বিজ্ঞানী
নোবেল কমিটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ভাষ্য- এই তিন বিজ্ঞানী ‘এক অজানা জগতের দুয়ার উন্মোচন’ করেছেন, যেখানে পদার্থ বিচিত্র দশায় বদলে যেতে পারে। এই গবেষণায় তারা সুপার কন্ডাক্টর, সুপার ফ্লুইড ও পালতা ম্যাকগনেটিক ফিল্মের আচরণ বুঝতে উচ্চতর গাণিতিক পদ্ধতি ব্যখবহার করেছেন। তাদের এই পথ দেখানো গবেষণার ফলে ইলেক্ট্রনিক্সে নতুন সম্ভাবনার আশা তৈরি হয়েছে।রসায়ন: মলিকিউলার মেশিন বা ন্যানোমেশিন উদ্ভাবনের গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে এবছর রসায়নের নোবেল জিতে নেন
রসায়নে নোবেল বিজয়ী তিন বিজ্ঞানীর একজন নেদারল্যান্ডসের বার্নার্ড এল. ফেরিঙ্গা দিচ্ছেন নোবেল বক্তৃতা
ফ্রান্সের জ্যঁ পিয়েরে সোভাজ, যুক্তরাজ্যের ফ্রেজার স্টুডার্ট এবং নেদারল্যান্ডসের বার্নার্ড এল. ফেরিঙ্গা।তাদের বিশ্বের ক্ষুদ্রতম যন্ত্রের উদ্ভাবক হিসেবে বর্ণনা করে নোবেল কমিটি বলেছে, তাদের গবেষণা রসায়ন শাস্ত্রকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।
শান্তি: পাঁচ দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানে ফার্ক গেরিলাদের সঙ্গে কলম্বিয়া সরকারের করা ‘ঐতিহাসিক’ শান্তিচুক্তি গণভোটে প্রত্যাখ্যাত হলেও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস।
নোবেল কমিটির হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করছেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস।
৫২ বছরের যে যুদ্ধ অন্তত দুই লাখ ২০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, প্রায় ৬০ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, সেই যুদ্ধের অবসানে ‘দৃঢ় অবস্থানের জন্য’ প্রেসিডেন্ট সান্তোসকে দেওয়া হয়েছে এ পুরস্কার।প্রেসিডেন্ট সান্তোস (৬৫) তার নোবেল পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন কলম্বিয়ার দীর্ঘ যুদ্ধে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত সব মানুষের প্রতি।
অর্থনীতি: আধুনিক অর্থনীতি শত সহস্র চুক্তিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা; আর চুক্তির সঙ্গে অর্থনীতির এই সম্পর্কের তত্ত্বতালাশে দুই গবেষক-
ব্রিটেনের অলিভার হার্ট ও ফিনল্যান্ডের বেংক্ট হলস্ট্রম।
বক্তৃতা দিচ্ছেন অর্থনীতি নোবেল বিজয়ী ফিনল্যান্ডের বেংক্ট হলস্ট্রম
কন্ট্রাক্ট থিওরি নিয়ে এই দুই গবেষকের কাজ বাস্তব জীবনের বিভিন্ন চুক্তি ও এর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহার বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চুক্তি কাঠামোর সম্ভাব্য জটিলতা চিহ্নিত করতেও তাদের তত্ত্ব কাজে এসেছে।
১৯৪৮ সালে লন্ডনে জন্ম নেওয়া হার্ট হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। আর বেংক্ট হলস্ট্রম ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক।
সাহিত্য: গত ১৩ অক্টোবর সাহিত্যে ১১৩তম নোবেল বিজয়ী হিসেবে ডিলানের নাম ঘোষণা করা হয়। নোবেলের ১১২ বছরের ইতিহাসে এ পুরস্কারজয়ী প্রথম সংগীত শিল্পী ও গীতিকার তিনি।
১৯৯৩ সালে ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের পর বব ডিলান প্রথম আমেরিকান, যিনি সাহিত্যে নোবেল পেলেন। তবে নোবেল জয়ের খবরে তাৎক্ষণিকভাবে ডিলানের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
১৪ দিন পর গত ২৯ অক্টোবর তিনি নোবেল কমিটিকে টেলিফোন করে পুরস্কার গ্রহণের কথা জানালে সেই গুঞ্জনের অবসান ঘটে।
কিন্তু গত ১৬ নভেম্বর তিনি রয়্যাল সুইডিশ একাডেমিতে চিঠি পাঠিয়ে পুরস্কার নিতে অসামর্থ্যের কথা জানান। ‘ব্যক্তিগত’ ওই চিঠিতে তিনি ডিসেম্বরে সুইডেন না যাওয়ার কারণ হিসেবে ‘পূর্ব প্রতিশ্রুত একটি অনুষ্ঠানের’ কথা উল্লেখ করেন। তবে তিনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করছেন না বলে নোবেল কমিটিকে আশ্বস্ত করেন।
নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার নিতে যাননি শুধু বব ডিলান
গান লেখা আর গাওয়া ছাড়াও ডিলান ছবি এঁকেছেন, অভিনয় করেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন। ১৯৭১ সালে তার লেখা গদ্য আর পদ্য নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘ট্যারেন্টুলা’, ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় ‘রাইটিংস অ্যান্ড ড্রইংস’, আর ২০০৪ সালে তার স্মৃতিকথা ‘ক্রনিকলস’।
ওয়ান্ডার্স বয়েজ চলচ্চিত্রে ডিলানের ‘থিংকস হ্যাভ চেইঞ্জড’ গানটি ২০০১ সালে অস্কার জিতে নেয়। ২০০৮ সালে পুলিৎজার পুরস্কারের জুরি বোর্ড যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য তাকে বিশেষ সম্মাননা জানায়। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১২ সালে ডিলানের গলায় পরিয়ে দেন ‘মেডাল অব ফ্রিডম’।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের পক্ষে নিউ ইয়র্কে আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশে জর্জ হ্যারিসন, রিংগো স্টার, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্যাটারসন, রবিশঙ্করের সঙ্গে ডিলানও ছিলেন; গেয়েছিলেন ‘এ হার্ড রেইন’স আ-গনা ফল’, ‘ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড’, ‘জাস্ট লাইক আ ওমেন’সহ কয়েকটি গান।