শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

ঢাবিতে উন্নয়ন ফি শিক্ষার্থীরা দিচ্ছে ‘আগ্রহভরে’

SONALISOMOY.COM
ডিসেম্বর ১১, ২০১৬
news-image

নিজস্ব প্রতিবেদক: কোনো বিভাগ নিচ্ছে আড়াই হাজার টাকা, কোনো বিভাগ নিচ্ছে সাড়ে ১৪ হাজার টাকা। কোনো নীতিমালা না থাকায় এভাবে বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো বিভাগ উন্নয়ন ফি নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

নিজের বিভাগের উন্নয়নে শিক্ষার্থীরা ‘আগ্রহভরে’ এ অর্থ দিচ্ছে বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ‌্যালয়ের উপাচার্য অধ‌্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

এই ফি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসা বাম সংগঠনগুলোর অন‌্যতম ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয় সভাপতি তুহিন কান্তি দাস বিরোধিতা করছেন উপাচার্যের এই বক্তব‌্যের।

তিনি বলছেন, এ ফি নেওয়ার আগে কোনো শিক্ষার্থীর মতামতই নেওয়া হয়নি, সুতরাং আগ্রহের বিষয়টি কিভাবে বোঝা যাবে?

এক অনুসন্ধ্যানে ২০১৬-১৭ সেশনে প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তিতে ২ হাজার ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা পর্যন্ত বিভাগ উন্নয়ন ফি’র নামে অর্থ আদায়ের তথ্য পাওয়া গেছে।

ভর্তি ফি’র বাইরে প্রতিবার ভর্তিতে এ ফি নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, বিভাগের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে তাদের চাহিদার আলোকে ডিনস কমিটির অনুমোদন নিয়ে ফি আদায় করা হয়।

উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের থেকে যে বেতন-ভাতা নিই, সে তুলনায় সেটা হয়ত বাড়তি। তবে বিভিন্ন বিভাগ তাদের চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়ন ফি নিয়ে থাকে।

“বিভাগের উন্নয়নের জন্য শিক্ষার্থীরাও টাকা দিতে আগ্রহী থাকে। কারণ তারা সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পিছিয়ে থাকতে চায় না।”

নির্দিষ্ট বিভাগের চাহিদা এবং সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি সুপারিশের আলোকে ডিনস কমিটি বিভাগ উন্নয়ন ফি নির্ধারণ করে দেয় বলে জানান তিনি।

উপাচার্যের যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা তুহিন দাস বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কথা বলে; কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের মতামত তুলে ধরার কোনো জায়গা কি আছে? নাকি বিরোধিতার কোনো সুযোগ আছে? কিছুই তো নেই।”

বিশ্ববিদ‌্যালয় কর্তৃপক্ষ নানা ছলে বিভিন্ন ফি বাড়িতে তুলেছে বলে তার অভিযোগ।

“শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের একটা কার্যক্রম তো বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে। তার অংশ হিসাবে উন্নয়ন ফি নেওয়া হয়, বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন হারে। যে বিভাগ যেভাবে চায়, সেভাবে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল থেকে পাস করিয়ে আনে।”

প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাইশা তাশরিন বলেন, “শুধু আদায় নয়, বছর বছর এটা বাড়াতেও চাই বিভিন্ন বিভাগ। ভর্তি ফি’র বাইরে অবৈধ এ উন্নয়ন ফি আমরা দেব কেন?”

তার বিভাগে এ বছর তৃতীয় বর্ষে ভর্তির সময় আগের বছর থেকে ৫০০ টাকা বাড়ানোর পর প্রতিবাদের মুখে আগের মতোই ৩ হাজার নেওয়া হয়েছিল জানান এই শিক্ষার্থী।

শীর্ষে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগ

উন্নয়ন ফি আদায়ের তথ্য জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮১টি বিভাগের মধ্যে ৩৬টির ২০১৬-১৭ সালে প্রথম বর্ষে ভর্তির তথ্য সংগ্রহ করা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিভাগীয় উন্নয়ন ফি নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগ, এবছর ভর্তিতে সেখানে নেওয়া হচ্ছে ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা।

বিভাগের একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৬-১৭ সেশনে প্রথম বর্ষে ভর্তি ফি ও উন্নয়ন ফি মিলে প্রতি শিক্ষার্থীকে গুণতে হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা। ভর্তি ফিও অন্যান্য বিভাগের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা বেশি।

পঞ্চম সেমিস্টারে ভর্তিতে ১৫ হাজার ৭৫০ টাকা, চতুর্থ সেমিস্টারে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং দ্বিতীয় সেমিস্টারে ১৩ হাজার টাকা বিভাগীয় ‍উন্নয়ন ফি নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান আরেক শিক্ষার্থী।

এর আগে বিভাগটিতে অতিরিক্ত ফি আদায় করে শিক্ষার্থীদের ‍বাড়তি ব্যয়ে বাধ্য করা হচ্ছে এমন অভিযোগে ২০১৪ সালে আন্দোলনে নেমেছিল বাম ছাত্র সংগঠনগুলো।

সেসময় বিভাগের শিক্ষার্থীরা ‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নেই’ যুক্তি দেখিয়ে ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে বিভাগ কর্তৃপক্ষ।

এই উন্নয়ন ফি’কে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের একটা কার্যক্রম হিসেবে দেখছে ছাত্র ইউনিয়ন

তবে উন্নয়ন ফি শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি ’চাপ’ তৈরি করছে বলে স্বীকার করেছেন বিভাগের বর্তমান চেয়ারপার্সন রিফফাত ফেরদৌস।

তিনি বলেন, “গ্রামের থেকে আসা অনেক শিক্ষার্থীদের সমস্যা হয়। তারা বিভাগের আবেদন করলে তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করা হয়।”

২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিভাগের এ সহকারী অধ্যাপক বলেন, বিভাগ খোলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ পাস করে দেয়। সে অনুসারী বিভাগ টাকা নিয়ে থাকে।

প্রতি সেমিস্টারে টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “সেমিস্টারে যত প্রাকটিক্যাল কোর্স থাকে, সে অনুসারে টাকা নেওয়া হয়ে থাকে।”

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভাগ উন্নয়ন ফি আদায়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অর্থনীতি বিভাগ।

এই বিভাগের একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা ১৩ হাজার ৯০০ টাকা উন্নয়ন ফি দিয়ে ভর্তি হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ের সবচেয়ে পুরনো বিভাগের একটি অর্থনীতিতে কোনো প্রাকটিক্যাল কোর্স নেই।

উন্নয়ন ফি আদায়ে তৃতীয় স্থানে থাকা পপুলেশন সায়েন্সেস এবং ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ৮ হাজার টাকা করে।

এ বছর গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের উন্নয়ন ফি সাড়ে ৭ হাজার টাকা আর আইন এবং লোক প্রশাসনে বিভাগের ৭ হাজার টাকা করে।

খোঁজ নেওয়া ৩৬টি বিভাগের মধ্যে উন্নয়ন ফি আদায়ে নিচের দিকে রয়েছে ইংরেজি বিভাগ এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ; এবার প্রথম বর্ষে তাদের এ খাতের ফি ২ হাজার ৩০০ টাকা। তবে সাংবাদিকতা বিভাগে মিডিয়া সেন্টার ফি হিসাবে ৩০০ টাকার ফি রয়েছে।

সান্ধ্যকালীন কোর্স ফি নিয়ে লুকোচুরি

উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের দেড় বছর মেয়াদী মাস্টার্স প্রোগ্রামে কোর্স ফি’র নামে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, “ভর্তির টাকার বাইরে বিশাল একটা টাকা আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু বলা হচ্ছে না, কোন খাতে কত টাকা। এটাকে টোকেন মানি বলছে তারা।”

বিভাগীয় অফিসে যোগাযোগ করা হলেও প্রধান সহকারী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার সঠিক সংখ্যাটি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

তিনি  জানান, দেড় বছর মেয়াদী মাস্টার্স কোর্সে মোট ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মতো লাগে। এর মধ্যে ভর্তি ফি’র বাইরে যে টাকা তার ৩০ শতাংশ যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে।

বিভাগের নোটিস বোর্ডে দেখা যায়, এ প্রোগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মোট ভর্তি ফি ৬ হাজার ৮৭৫ টাকা। আর বাইরের শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি ৮ হাজার ১৭৫ টাকা।

তবে ভর্তি ফি’র বাইরে যে টাকা নেওয়া হচ্ছে, তা কোন কোন খাতে নেওয়া হচ্ছে তা জানা নেই বলে দাবি করেন ডেভেলমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফও।

তিনি  বলেন, “আমি আসলে ঠিক জানি না। ওরা (বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী) নিচ্ছে।”

সান্ধ্যকালীন এমবিএ-তে উন্নয়ন ফি ১০ হাজার টাকা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে বড় পরিসরে সান্ধ্যকালীন এমবিএ কোর্স আটটির সঙ্গে এবার আরেকটি বাড়ছে।

সান্ধ্যকালীন এমবিএ-তে উন্নয়ন ফি হিসাবে ১০ হাজার টাকা দিতে হয় বলে জানিয়েছেন অনুষদের সান্ধ্যাকালীন এমবিএ’র কো-অর্ডিনেটিং অফিসার সহিদুর রহমান।

তিনি  জানান, সান্ধ্যকালীন এমবিএ-তে প্রথম বর্ষে ভর্তির সময় উন্নয়ন ফি ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। এরপর তিন বছরে ২ হাজার টাকা করে মোট ৬ হাজার টাকা দিতে হবে।

মোট খরচের হিসাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “এমবিএ-এর জন্য ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, এর মধ্যে সেমিস্টার ফি প্রতি সেমিস্টারে ৫ হাজার টাকা। রেজিস্ট্রেশন ফি ১০ হাজার টাকা, কম্পিউটার ব্যবহার ফি ৫ হাজার টাকা লাগে।”

বিভাগ অনুযায়ী মোট খরচের কিছুটা তারতম্য আছে বলে জানান তিনি।

ফিন্যান্স বিভাগের সান্ধ্যকালীন এমবিএ’র সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সেলিনা আকতার জানান, সান্ধ্যকালীন এমবিএ’র ক্ষেত্রে প্রতিটি বিভাগের কোর্স ফি ও সেমিস্টার ফি নির্ধারিত।

প্রতি সেমিস্টারের ফি ৫ হাজার টাকা এবং বিভাগ অনুযায়ী ২০-২২টি কোর্সে প্রতিটির ফি ১০ হাজার ৫০০ টাকা বলে জানান তিনি।

এক প্রশ্নে সেলিনা বলেন, “পাঁচ বছরের মধ্যে ২০-২২টি কোর্স শেষ করতে হয়। এর জন্য যত সেমিস্টার লাগবে, ততটির ফি পাঁচ হাজার করে দিতে হয়।”