মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি

SONALISOMOY.COM
ডিসেম্বর ১১, ২০১৬
news-image

রবীন্দ্রনাথের দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য বিজ্ঞান আছে। বিজ্ঞানে সত্য উদ্‌ঘাটনের সুযোগ অবারিত। ‘কার্বন ডটিং’-এর মাধ্যমে যেমন ঐতিহাসিক সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, আবার ‘ডিএনএ’ পরীক্ষার সাহায্যে উদ্ধার করা যায় বংশ পরিচয়; যাচাই করা যায় অনেক বিতর্কিত বিষয়। বিজ্ঞানে বিতর্কের সুযোগ আছে; আছে ভুল সংশোধনের স্বাধীনতা। এটি ধর্মের কথা নয় যে ঘাড় নুয়ে বিশ্বাস করতে হবে! এখানে সত্যাসত্য যাচাইয়ের নিক্তি আছে, আছে কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা।

আজ থেকে প্রায় এক শ বছর আগে আইনস্টাইন ও বোরের মধ্যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নান্দনিকতা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে তা ‘কোপেনহেগেন বিতর্ক’ নামে সমাধিক পরিচিত। বিজ্ঞানীদের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ হয়েছিল। কিন্তু কেউ কাউকে রামদা নিয়ে কোপাতে যাননি। যুগে যুগে গ্রহণ ও বর্জনের মাধ্যমে বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। কোপেনহেগেন বিতর্কের অবসান ঘটাতে দৃশ্যপটে এসেছিলেন বেল। অসম্পূর্ণ রেখে তিনিও বিদায় নিয়েছেন। এসেছেন আরও অনেকে; পারেননি সব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছিদ্র বন্ধ করে সফল পরীক্ষার মাধ্যমে সত্য উদ্‌ঘাটন করতে।

২০১৬ সালে কি শতবর্ষী কোপেনহেগেন বিতর্কের যবনিকা হতে যাচ্ছে? তবে বিধাতা কি জুয়া খেলেন? হয়তোবা! না হলে, আইনস্টাইনের ভৌতিক ক্রিয়া না হয়ে ‘কোয়ান্টাম এনটাংগেলমেন্ট’ (বিজড়ায়ন) কেন বাস্তব হতে যাচ্ছে?

পদার্থবিজ্ঞানে ‘প্যারডক্স’ সুপরিচিত একটি বিষয়। যেমন: টোয়াইন প্যারাডক্স, বাগ-রিবেট প্যারাডক্স, শ্রোয়েডিঞ্জার ক্যাট প্যারাডক্স ইত্যাদি। তেমনি একটি প্যারাডক্স হল, আইনস্টাইন-পোডলস্কি-রোজেন প্যারাডক্স বা ইপিআর প্যারাডক্স। ১৯৩৫ সালে এই ত্রয়ী কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সম্পূর্ণতার নান্দনিক ব্যাখ্যা দিতে একটি বিখ্যাত নিবন্ধ লেখেন। বিজড়িত বস্তুদ্বয়ের একটি যদি অপরটি থেকে দূরে অবস্থিত হয় তবে একটির পরীক্ষণ অন্যটিকে প্রভাবিত করতে পারে– এ ধারণাকে বাতিল করে দিয়ে তাঁরা বস্তুর স্থানীয় বাস্তবতা প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

১৯৬৪ সালে দৃশ্যপটে বেলের আগমণের পূর্বে বিজ্ঞানীরা তেমনই বিশ্বাস করতেন। তবে তখনও বিতর্ক চলছিল। বেল স্থানীয় বাস্তবতাকে স্টান্ডার্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিরুদ্ধে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যা ‘বেলের অসমতা’ নামে পরিচিত।

বেলের ভবিষ্যদ্বাণী বা আইনস্টাইনের ধারণা কোনটি সঠিক– এ নিয়ে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা চলে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। সম্ভবত এই প্রথম প্রফেসর আলেইন আসপেক্টের পরীক্ষণ আইনস্টাইনের স্থানীয় বাস্তবতার ধারণা প্রত্যাখ্যান করতে যাচ্ছে।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিকাশে আইনস্টাইনের ভূমিকা অপরিসীম। তিনিই সর্বপ্রথম শক্তির কোয়ান্টাইজেশন সফলভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনিই প্রথম আলোর দ্বিচারিতা সফলভাবে ব্যাখ্যা করেন। অথচ তিনি নীলস বোরের কোয়ান্টাম থিওরি (কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা) নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন।

তিনি মনে করতেন, হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র অসম্পূর্ণ। বোর আইনস্টাইনের সব আপত্তির সফল নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছিলেন। আইনস্টাইন মনে করতেন, বিজড়িত বস্তুদ্বয়ের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বজায় থাকবে কেবল তখনই, যদি তথ্য আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে প্রবাহিত হতে পারে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাহলে কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা সঠিক হতে পারে না।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উৎকর্ষে যাঁর অবদান অপরিসীম তিনি কি না কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে অসম্পূর্ণ ভাবতেন! যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনেক কিছুর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে, তাই বিজ্ঞানীদের অনেকে বোর ও আইনস্টাইনের বিতর্কে মনোযোগ দেননি।

এই বিতর্ক তখনই বিজ্ঞানীদের আকর্ষণ করেছেন যখন বেলের পরীক্ষণের ফলাফল আইনস্টাইনের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হল। বেল তাঁর পরীক্ষণে লুকায়িত চলকের সন্ধান করে বিজড়িত বস্তুদ্বয়ের আচরণের সফল ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন।

প্রায় একই সময়ে, অর্থাৎ ২০১৫ সালের শেষদিকে ভিয়েনা, এনআইএসটি ও ডাচ বিজ্ঞানীদের একটি দল ভিন্ন ভিন্নভাবে সফল পরীক্ষা করে আইনস্টাইনের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। এ ক্ষেত্রে প্রায় শত বছর ধরে পদার্থবিজ্ঞানীরা নিরন্তর চেষ্টা করছেন কোয়ান্টাম বিজড়ায়ান ব্যাখ্যা করার, যা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রকে পরাভূত করে। সাব-অ্যাটোমিক বস্তুকণার ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম বিজড়ায়ান ঘটতে পারে। আর ইলেকট্রন হল তেমন একটি সাব-অ্যাটোমিক বস্তুকণা।

ইলেকট্রন চুম্বকীয় ধর্ম হল ‘স্পিন’ যা ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট হয়। এ স্পিন ঊর্ধ্বমুখী না নিম্নমুখী তা নিশ্চিত করে বলা যায় না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না তাদের পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখা হয়। কয়েন টসের ক্ষেত্রে যেমন হেড বা টেলের বিষয়টি অনিশ্চিত, যতক্ষণ পর্যন্ত না তালুবন্ধ করে দেখা হয়।

প্রফেসর রোনাল্ড হেনসন বলেন–

“দুটি ইলেক্ট্রনের বিজড়িত হওয়ার ঘটনা খুবই কৌতুহল উদ্দীপক। বিজড়িত ইলেক্ট্রনদ্বয়ের স্পিন একই সময়ে ঊর্ধ্ব ও নিম্নমুখী হতে পারে। কিন্তু যখন এদের পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখা হয় তখন একটির স্পিন ঊর্ধ্বমুখী হলে অন্যটির নিম্নমুখী হবে। সুতরাং তারা যথাযথভাবে সম্পর্কিত।”

এ প্রভাব তাৎক্ষণিক, এমনকি একটি ইলেকট্রন রকেটে ও অন্যটি কোনো এক গ্ল্যালাক্সিতে থাকলেও এটি ঘটা সম্ভব। অন্যসব সাব-অ্যাটোমিক বস্তুকণাসমূহ একইভাবে বিজড়িত হবে।

ডাচ বিজ্ঞানীরা দুটি বিজড়িত ইলেকট্রনকে এক কিলোমিটারের চেয়ে অধিক দূরত্বে রেখে সফলতার সঙ্গে পরীক্ষণ সম্পন্ন করেন। পরীক্ষালব্দ ফলাফল থেকে এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে–

“কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে বিজড়িত বস্তুদ্বয়ের মধ্যকার দূরত্ব যা-ই হোক না কেন তারা পরস্পর সম্পর্কিত। বস্তুদ্বয়ের একটির যে কোনো ধরনের পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে অন্যটির আচরণে পরিবর্তন ঘটাবে। এমনটি ঘটার জন্য বস্তুদ্বয়ে মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানের গতি আলোর গতির চেয়ে বেশি হওয়ার দরকার নেই।”

আরও মজার বিষয় হল, অতিসম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির কোয়ান্টাম ডাইনামিকস সেন্টারের একদল বিজ্ঞানী ফোটন নামক অপর একটি সাব-অ্যাটমিক বস্তুকণাকে বিভাজিত করে দেখান যে একক বস্তুকণার ক্ষেত্রেও কোয়ান্টাম বিজড়ায়ন সম্ভব। তারা একটি ফোটনকে দুটি ল্যাবে বিভাজিত করে হোমোডাইনামিক ডিটেক্টরের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখান যে বিভাজিত অংশ দুটির একটির স্থানীয় অবস্থার পরিবর্তনে অন্যটির অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কোয়ান্টাম বিজড়ায়ন শুধু দুটি সাব-অ্যাটমিক বস্তুকণার ক্ষেত্রে নয় একটি বস্তুকণার দুটি বিভাজিত অংশের মধ্যে ঘটতে পারে।

দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ সমস্যার সমাধান হয়ত সধারণের মধ্যে আলোড়ন তোলেনি। কিন্তু এটি অবধারিত যে কোয়ান্টাম বিজড়ায়ন সত্য হতে যাচ্ছে। কোয়ান্টাম ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন টেকনোলজিতে ঘটতে যাচ্ছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন, যা মানবসভ্যতাকে নিঃসন্দেহে একধাপ এগিয়ে নেবে।

যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে যেসব জাগতিক পরিবর্তন সাধিত হবে তা হল– সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘড়ি, অলঙ্ঘনীয় পাসওয়ার্ড, সুপার কম্পিউটার, অত্যাধুনিক মাইক্রোফোন ও বায়োকম্পাস।

এ আবিষ্কার দ্বার উম্মোচন করবে কোয়ান্টাম লজিক ঘড়ির, যা ৩.৭ বিলিয়ন বছরে মাত্র এক সেকেন্ড সময় হারাবে। এ ঘড়ি জিপিএস নেভিগেশন, টেলিযোগাযোগ ও জরিপ কাজে ব্যবহার করা যাবে। অলঙ্ঘনীয় পাসওয়ার্ড, যাকে কোয়ান্টাম চাবি বলা যায়। কোনো তথ্য আদানপ্রদানে, ব্যাংকে অর্থের লেনদেনে সিকিউরিটি কোর্ড হিসাবে এ কোয়ান্টাম চাবি ব্যবহার করে সুরক্ষা দেওয়া যাবে। হয়তো কিছুদিন পরে বাজারে আসবে সুপার কম্পিউটার বা কোয়ান্টাম কম্পিউটার, যা সাধারণ কম্পিউটারে ব্যবহৃত বিটের পরিবর্তে কিউবিট ব্যবহার করবে– যাতে কম্পিউটারের প্রসেসরের গতি বৃদ্ধি করা যাবে।

মাইক্রোফোন বিজড়িত ফোটনের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে তথ্য জোগাড় করতে পারবে। মানুষ যে শুধু কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করবে তা নয়। পাখিরা মানুষের আগে কোয়ান্টাম বিজড়ায়ন ব্যবহার করে। তাই হয়ত প্রকৃতিকে জ্ঞানের আধার বলা হয়। মনে করা হয়, ইউরোপিয়ান রবিন বার্ড চলার জন্য বায়োকম্পাস হিসাবে কোয়ান্টাম বিজড়ায়ন ব্যবহার করে।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভৌতিক ক্রিয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ছিলেন আইনস্টাইন। আইনস্টাইন, বোর, হাইসেনবার্গ, বেলরা আজ স্বর্গে। কিন্তু মর্ত্যের বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বায়ন তথা বৈশ্বিক বাস্তবতার যুগে আইনস্টাইনের স্থানীয় বাস্তবতার ধারণা অচল। বেঁচে থাকলে আইনস্টাইন বেশি খুশি হতেন। কারণ, বিজ্ঞানের নান্দনিকতা যে সত্য উদ্‌ঘাটনে।

একবার আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “যদি আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হত তবে কি করতেন?”

আইনস্টাইন বলেছিলেন, “জার্মানরা বলত আইনস্টাইন ইহুদি, বিশ্ববাসী বলত আইনস্টাইন জার্মান। এখন জার্মানরা বলছে আইনস্টাইন জার্মান, আর বিশ্ববাসী বলছে আইনস্টাইন বিশ্বনাগরিক।”

জীবদ্দশায় আইনস্টাইনকে বস্তুর স্থানীয় বাস্তবতার বিষয়ে এমন প্রশ্ন কেউ করেনি। কিন্তু কোয়ান্টাম বিজড়ায়ন সত্য, তথাপি আইনস্টাইন বিশ্বনাগরিক।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ব্যতিত সফলতা অসম্ভব। আর নিরন্তর প্রচেষ্টার জন্য চাই অবারিত সুযোগ।

“দরজা খুলে দাও জানালা খুলে দাও
আসতে দাও হাওয়া উঠুক ভরে বুক
রোদের আরশিতে দেখতে দাও মুখ।