আশুলিয়ায় ২৪৯ শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা
নিজস্ব প্রতিবেদক : শ্রমিক বিক্ষোভে ‘উসকানি ও শৃঙ্খলাভঙ্গের’ অভিযোগে আড়াইশ শ্রমিককে আসামি করে দুটি মামলা করেছে আশুলিয়ার দুটি পোশাক কারখানার মালিকপক্ষ।
আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) একেএম শামীম হাসান জানান, উইন্ডি অ্যাপারেলস লিমিটেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাসুদ রানা ও ফাউনটেইন গামের্ন্টসের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) নাজমুল হক মামলা দুটি দায়ের করেন।
“দুই মামলাতেই কারখানার ভেতরে ভাংচুর, অসন্তোষ সৃষ্টির পাঁয়তারা, শ্রমিকদের উসকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আসামিদের সনাক্ত করার কথা বলা হয়েছে এজাহারে।”
কারখানা কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার মধ্যরাতে থানায় অভিযোগ দাখিল করলে বুধবার সকালে সেগুলো মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয় বলে জানান তিনি।
উইন্ডির মামলার আসামিদের মধ্যে ওই কারখানার কাটিং অপারেটর মাসুদ (২৮) ও কাটিং সহকারী বাকেরকে (২৫) ইতোমধ্যে জামগড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ।
এছাড়া বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে ১২১ জন শ্রমিককে সাময়িক বরখাস্ত করে বুধবার সকালে কারখানার ফটকে তাদের ছবি ও নোটিস টাঙিয়ে দিয়েছে উইন্ডি অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ।
ন্যূনতম ১৬ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে কাজ বন্ধ রাখা আশুলিয়ার অর্ধশতাধিক পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে সরকার ও মালিক সমিতির কঠোর অবস্থানের মধ্যেই দুই কারখানার পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপ নেওয়া হল।
জামগড়া এলাকার উইন্ডি কারখানার শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধিসহ ১৬ দফা দাবিতে গত ১২ ডিসেম্বর কর্মবিরতি শুরু করে। কাজ বন্ধ রেখে বিক্ষোভের এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় এবং সে সময় শ্রমিকরা কারখানায় ভাংচুর চালায় বলে কর্তৃপক্ষের অভিযোগ।
উইন্ডি কর্তৃপক্ষের করা মামলায় ২১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও দেড়শ শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার মাসুদ ও বাকেরের নামও রয়েছে বলে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মাসুদ রানা জানান।
বরখাস্তের বিষয়ে জানতে চাইলে উইন্ডির প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ কে এম ফজলুল হক বলেন, “কারখানার ভেতরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে এমন ১২১ জনকে মঙ্গলবার রাতে ‘ব্ল্যাক লিস্টেড’ করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের ছবিসহ ওই নোটিস দেওয়া হয়েছে।”
তালিকায় থাকা শ্রমিকদের বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে ওই নোটিসে।
তাতে কারও সই বা সিদ্ধান্তদাতা কর্মকর্তার নাম না থাকার কারণ জানতে চাইলে ফজলুল হক বলেন, “সেটা কর্তৃপক্ষের বিষয়।”
ওই ১২১ জনের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানায় বরখাস্তের চিঠি পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিদর্শক শামীম বলেন, শ্রমিক বরখাস্তের সিদ্ধান্তে নিলে বিশৃঙ্খলা এড়াতে কারাখানা কর্তৃপক্ষ সাধারণত পুলিশকে তা জানায়। তবে উইন্ডি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি থানায় অবহিত করেনি।
ফাউনটেইন গামের্ন্টসের করা মামলাতেও একই ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহারে ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৬০ জনকে সেখানে আসামি করা হয়েছে বলে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাহাদাৎ হোসেন জানিয়েছেন।
উইন্ডি ও ফাউনটেইন গামের্ন্টসের শ্রমিকদের আন্দোলন ধীরে ধীরে আশপাশের অন্যান্য কারখানায় ছড়িয়ে পড়লে গত সোমবার ২৫টি কারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে বিক্ষোভ শুরু করেন। এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রী, নৌমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেও আন্দোলন অব্যাহত থাকে; মঙ্গলবার কাজ বন্ধ থাকে ৫৫ কারখানায়।
বিভিন্ন সংগঠনের শ্রমিকনেতাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা আন্দোলনে সমর্থন না দিলেও শ্রমিকরা নিজেরাই সংগঠিত হয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
আর এ বিষয়টি ধরেই শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কোনো একটা পক্ষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই খাতের ক্ষতি করতে অসন্তোষ সৃষ্টি করছে।
শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে ‘অবৈধ’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, শ্রমিকরা কাজে না ফিরলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এরপর পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান মঙ্গলবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই ৫৫ কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন, শ্রমিকরা যতদিন কাজে যোগ না দেবে ততদিনের বেতন তারা পাবে না।
বিজিএমইএর ওই সিদ্ধান্ত বুধবার থেকেই কার্যকর করা হয়। বুধবার সকালে কারখানায় এসে নোটিস দেখে ফিরে যান বন্ধ কারখানাগুলোর অনেক কর্মী।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ১৫ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয় আশুলিয়ায়। সেই সঙ্গে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বাইপাইল থেকে জিরাব পর্যন্ত পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও আর্মড পুলিশের টহল চলতে থাকে।
কড়া নিরাপত্তায় এই থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেই শ্রমিকদের মিছিল-মিটিং থেকে বিরত রাখার জন্য মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। বলা হয়, মিছিল-মিটিংয়ের চেষ্টা করলে ‘আইনানুগ ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে।
আন্দোলনরত শ্রমিকদের দাবিগুলো হল- সর্বনিম্ন বেতন ৫ হাজার ৩০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১৬ হাজার টাকা করা; কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; দুপুরে খাবার ও যাতায়াত ভাতা বৃদ্ধি; ছুটির দিনে ওভার টাইম বিল দ্বিগুণ করা; যখন-তখন শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা; কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হলে চাকরির বয়স পর্যন্ত আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ; তাজরীনসহ সব কারখানায় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা; শিল্পাঞ্চলে সরকারি স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ এবং নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া।