শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

নূর হোসেনের সাম্রাজ্য কার হাতে?

SONALISOMOY.COM
জানুয়ারি ১৮, ২০১৭
news-image

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নূর হোসেন এলাকায় নেই। কিন্তু তাঁর হাতে গড়া অবৈধ সাম্রাজ্য বহাল আছে। এখনো লোকে তাঁকে চেয়ারম্যান হিসেবে ডাকে। নূর হোসেনের হয়ে প্রতিদিন সিদ্ধিরগঞ্জে চাঁদাবাজি, দখল ও মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। খুনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন কেউ কেউ। নতুন করে এলাকায় সরকারি জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট। এই নূর হোসেন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।

সিদ্ধিরগঞ্জের মুক্তিনগরে পাউবোর জায়গা ভরাট করে নূর হোসেন ও তাঁর ভাতিজারা গড়ে তুলেছেন মার্কেট l ছবি: আবদুস সালামনারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে। আলোচিত সাত খুনের মামলায় নারায়ণগঞ্জের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এলাকাবাসীর ভাষ্য, সাত খুনের আগে নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জে জমি দখল, চিটাগাং রোড ও শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে চাঁদাবাজি, শীতলক্ষ্যা থেকে বালু উত্তোলন, নদীতীর দখল, মাদক ব্যবসা ও জুয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি নূর হোসেন ছিলেন স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। শামীম ওসমানের সব কর্মসূচিতে নিয়মিত দেখা যেত তাঁকে। যেদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে সাতজনকে অপহরণ করা হয়, সেদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের রাইফেলস ক্লাবে শামীম ওসমানের সঙ্গে নূর হোসেন অবস্থান করেন। গণমাধ্যমকর্মীরাও এই দৃশ্য দেখেছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর নূর হোসেনের সঙ্গে শামীম ওসমানের টেলিফোন সংলাপ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তাঁকে দেশ ছেড়ে পালাতেও শামীম ওসমান সাহায্য করেছেন বলে সে সময় অভিযোগ ওঠে। সাত খুন মামলার বিচার শুরু হলে প্রধান আসামি নূর হোসেনের আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা, যিনি নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত।

নূর হোসেনের ভাতিজা মো. শাহীন। খুনের মামলায় গ্রেপ্তারের পর এখন রিমান্ডেসাত খুনের ঘটনা প্রকাশের পর শামীম ওসমান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘নূর হোসেন আমার কর্মী ছিল। কিন্তু সে যে এত বড় অপরাধী, সে যে নজরুলকে খুন করে ফেলতে পারে, এটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এখন আমি সব বুঝতে পারছি। তাই নূর হোসেনের ব্যাপারে আমার অবস্থান বদলেছে।’
সাত খুনের মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে তখন বলেছিলেন, তাঁদের কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে, অপহরণের দুই দিন পর ২৯ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টার দিকে শামীম ওসমানকে ফোন করেন নূর হোসেন। দুই মিনিটের মতো কথা হয় তাঁদের মধ্যে৷ এই কথোপকথনের রেকর্ড তাঁদের হাতে আছে। শামীম ওসমানকে ফোন করার সময় ধানমন্ডি ৪ নম্বর সড়কের আশপাশে ছিল নূর হোসেনের অবস্থান৷
রেকর্ডে কী আছে, জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, শামীম ওসমানকে ফোন করেন নূর হোসেন। তিনি ফোন ধরে বলেন, ‘খবরটা পৌঁছাই দিছিলাম, পাইছিলা?’ জবাবে নূর হোসেন বলেন, ‘পাইছি, ভাই।’ শামীম ওসমান বলেন, ‘তুমি অত চিন্তা কোরো না।’ নূর হোসেন এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে শামীম ওসমানকে বলেন, ‘ভাই, আমি লেখাপড়া করিনি। আমার অনেক ভুল আছে। আপনি আমার বাপ লাগেন। আপনারে আমি অনেক ভালোবাসি, ভাই। আপনি আমারে একটু যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।’ জবাবে শামীম ওসমান বলেন, ‘এখন আর কোনো সমস্যা হবে না।’ শামীম ওসমান ‘গৌরদা’ বলে এক লোকের সঙ্গে নূর হোসেনকে দেখা করতে বলেন।
কথোপকথনের এই পর্যায়ে নূর হোসেনের কাছে শামীম ওসমান জানতে চান, কোনো সিল (সম্ভবত ভিসা) আছে িক না। সিল থাকার কথা জানিয়ে নূর হোসেন বলেন, ‘আছে আছে, সিল আছে, কিন্তু যামু ক্যামনে? যেভাবে বলল অ্যালার্ট (রেড অ্যালার্ট)।’ শামীম ওসমান বলেন, ‘তুমি আগাইতে থাকো।’ নূর হোসেন তখন বলেন, ‘ভাই, তাহলে একটু খবর নেন। আমি আবার ফোন দেই।’

কথাবার্তার একপর্যায়ে শামীম ওসমান নূর হোসেনকে বলেন, ‘তুমি কোনো অপরাধ করো নাই। আমি জানি, ঘটনা অন্য কেউ ঘটাইয়া এক ঢিলে দুই পাখি মারতেছে।’ এ সময় শামীম ওসমান নূর হোসেনের কাছে জানতে চান, এই নম্বরটি (ফোন) নতুন কি না৷ নূর হোসেন ‘হ্যাঁ-সূচক’ জবাব দেন৷ শামীম ওসমান বলেন, তিনি নূর হোসেনকে তাঁর আরেকটি নম্বর পাঠাবেন যোগাযোগের জন্য৷

এই ফোনালাপ সম্পর্কে শামীম ওসমান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ঘটনার পর তো নূর হোসেন আমাকে কয়েকবার ফোন করেছিল। একটি অচেনা নম্বর থেকে আসা ফোন আমি বোধ হয় একবার ধরেছিলাম। সে বারবার বলছিল, সে এই কাজ করতে পারে না। খুব বেশি কথাবার্তা আর হয়নি। আর সে তো তখন নারায়ণগঞ্জেই ছিল।’ ভারতে চলে যাওয়ার আগে কথাবার্তা হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে শামীম ওসমান তখন বলেছিলেন, ‘আমি বলতে পারব না সে তখন কোথায় ছিল।’

সাত খুনের ঘটনায় নূর হোসেন নারায়ণগঞ্জ ছাড়লে তাঁর জায়গা নেন তাঁর ভাতিজারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুজন নেতা বলেন, নূর হোসেনের জায়গা নিতে চাইছেন তাঁর ভাতিজা কাউন্সিলর শাহজালাল বাদল। পরপর দুবার তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক এবং স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ। সাত খুনের পর বাদলও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। এখন তিনি জামিনে আছেন। এলাকায় তাঁর প্রভাব অনেক বেশি। সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে।

এসব বিষয়ে জানতে কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তাঁর পিএস ফোন ধরে বলেন, ‘পরে ফোন দেন।’ এরপর একাধিকবার তাঁর মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। সন্ধ্যা সাতটার পর তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পরপরই এলাকা ত্যাগ করেন নূর হোসেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের এক নেতা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নূর হোসেন এলাকায় না থাকলেও তাঁর সাম্রাজ্য দখলে রেখেছেন তাঁর ভাতিজা কাউন্সিলর শাহজালাল বাদল, সোহেল ও শাহিন।

সরেজমিনে দেখা গেল, নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডের উত্তর পাশে হক সুপার মার্কেট। এর সামনে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় বালু ভরাট করে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে মার্কেট। কাউন্সিলর বাদলের তত্ত্বাবধানে তাঁর লোকজনই এই মার্কেট গড়ে তুলেছেন। দোকানগুলো ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে একটি ফ্যাশন হাউস সেখানে দোকানও নিয়েছে।

জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা ডিভিশন-১) আবদুল আওয়াল মিয়া গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জানতে পেরেছি, সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করে মার্কেট করা হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারাই এই জায়গা দখল করেছেন। শিগগিরই পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় তৈরি করা মার্কেট উচ্ছেদ করে দখলে নেওয়া হবে। দখলকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করব।’

নূর হোসেনের ভাতিজার দখলে শিমরাইলের টেম্পো-লেগুনাস্ট্যান্ড

কাউন্সিলর নূর হোসেনের দখলে থাকা শিমরাইলের টেম্পো ও লেগুনাস্ট্যান্ড এখন তাঁর আপন ভাতিজা সোহেলের দখলে। শিমরাইল স্ট্যান্ডে টেম্পো চলে ১০০টি, লেগুনা ৬০টি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ৫০টি।

সরেজমিনে দেখা যায়, টেম্পোচালকদের কাছ থেকে সোহেলের কর্মচারী মনা চাঁদা আদায় করছেন। দিনে প্রতিটি টেম্পো থেকে ৮০ টাকা, লেগুনা থেকে ১০০ টাকা এবং অটোরিকশা থেকে ১০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। মনা বলেন, ‘সোহেল ভাই এই স্ট্যান্ড লিজ নিয়েছেন। টেম্পো ও লেগুনা থেকে প্রতিদিন টাকা আদায় করা হয়।’ তবে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য সোহেলের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।

নূর হোসেনের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ সহযোগী রাজুর হাতে

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলে ব্যস্ততম মুক্তি সরণির মোড়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) জলাশয় ভরাট করে প্রাইভেট কারের স্ট্যান্ড গড়ে তোলেন নূর হোসেন। এখন এই স্ট্যান্ড দখলে নিয়েছেন নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আমিনুল হক ওরফে রাজু। তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতিও। জানা গেছে, এই স্ট্যান্ডে গাড়ি আছে ১৪০টি। প্রতি মাসে প্রতিটি গাড়ি থেকে তিন হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।

সওজের প্রকৌশলী জাকির আলম বলেন, ‘নূর হোসেন তাঁদের জায়গা দখল করে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড গড়ে তোলেন। তাঁর লোকজন এখনো দখলে রয়েছেন। তবে আমিনুল হক প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সরকারি জায়গায় জনস্বার্থেই ট্যাক্সিস্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। চাঁদাবাজি করা হয় না।

সিদ্ধিরগঞ্জের মাদক ব্যবসা জমজমাট

শিমরাইল এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানালেন, নূর হোসেন গাঁজা, ইয়াবা, ফেনডিসিল ও হেরোইনের ব্যবসা করতেন। নূর হোসেন কারাগারে থাকলেও তাঁর হয়ে মাদক ব্যবসা করছেন তাঁর ভাতিজারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জে মাদক ব্যবসার গডফাদার ছিলেন নূর হোসেন। মাদক ব্যবসার কারণে ভাতিজা শাহীন গ্রেপ্তারও হয়েছেন।

খুনের মামলায় গ্রেপ্তার নূর হোসেনের ভাতিজা

সাত খুন মামলার রায় ঘোষণার দিন গত সোমবার বিকেলে একটি খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন নূর হোসেনের এক ভাতিজা। তাঁর নাম মো. শাহীন। তিনি নূর হোসেনের আপন ভাই নূরুল ইসলামের ছেলে। ৩ জানুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকার গজারি বাগানের সামনে খুন হন মাহবুবুর রহমান (২৫) নামের এক ব্যক্তি।

জানতে চাইলে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সরাফত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই খুনে জড়িত থাকার অভিযোগে নূর হোসেনের ভাতিজা শাহীনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি একাধিক মাদক মামলার আসামি। নিহত মাহবুবুর রহমান একজন ট্রাকচালক। মাহবুবকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। তাঁর কাছ থেকে আসামিরা টাকাপয়সাও ছিনিয়ে নিয়েছে।