মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু আইন বাতিল চায় পুলিশ

SONALISOMOY.COM
জানুয়ারি ২৪, ২০১৭
news-image

অনলাইন ডেস্ক:

‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছে পুলিশ। একই সঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এলে বিচারিক আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন বলে আদালত সম্প্রতি যে রায় দিয়েছেন, সেটিও পুলিশের অধিকারকে খর্ব করছে বলে দাবি পুলিশের।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রথমবারের মতো পুলিশের কল্যাণ সভায় এসব দাবি তোলা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য আইন বাতিলের কোনো আশ্বাস দেননি। তবে আদালতের নির্দেশনামূলক রায়ের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এ ধরনের রায় কেন দিল, তা জানি না। যেহেতু আদালতের রায়, আমাদের হাত-পা-মুখ বন্ধ, কিছু বলতে পারি না। কিন্তু আমরা কি আইনশৃঙ্খলা, মানুষের জানমাল রক্ষা করব না? পুলিশ কাজ করবে না? পুলিশের হাত-পা যদি বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করবে কীভাবে? দশটা ভালো কাজ করতে গেলে একটা-দুটো ভুল হতে পারে।’
রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শহীদ সিরু মিয়া মিলনায়তনে ওই কল্যাণ সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সব পদের সদস্য ও কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় পাঁচজন কর্মকর্তা ও সদস্য বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী এর জবাব দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পুলিশের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্টি ও আনন্দ প্রকাশ করেন। তিনি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা রাজারবাগের কর্মসূচিতে ছিলেন।
কল্যাণ সভার শুরুতেই আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই পুলিশের সম্প্রসারণ হয়, উন্নয়ন ঘটে। পদোন্নতি না হলে নিচের পদগুলোতে যে হতাশা আসে, এখন সেটিও হচ্ছে না। পুলিশে প্রচুর পদোন্নতি হচ্ছে। রোদ-বৃষ্টি, ধুলাবালুর মধ্যেই পুলিশের বেশির ভাগ সদস্য ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করেন। সরকারের নীতি বাস্তবায়নে পুলিশ কাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি কিছু বলার সুযোগ চাইছিলেন। আজ সেই দিন। তাঁদের কোনো আর্থিক দাবিদাওয়া নেই। তবু কেউ কিছু বলতে চান।
প্রথমেই ঢাকা মহানগর পুলিশের কনস্টেবল খায়রুন্নাহার পোশাকের অপ্রতুলতার কথা বলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী এখন থেকে পুলিশের জন্য প্রতিবছর তিন সেট হাফহাতা ও এক সেট ফুলহাতা ইউনিফর্ম সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
সার্জেন্ট মশিউর রহমান ব্যারাক ও পুলিশের থাকার জায়গার স্বল্পতার কথা বলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবাসন সমস্যার বিষয়ে তিনি সব সময় সচেতন। রাজারবাগে কোনো দাবি করা ছাড়াই বহুতল ভবন করে দেওয়া হয়েছে। জেলা-উপজেলায় পুলিশের জন্য প্রকল্প করে বহুতল ভবন করা হচ্ছে।
পুলিশের সার্জেন্ট ও এসআই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ পোষ্য কোটা প্রবর্তনের দাবি তোলেন এসআই সুজন কুমার কুণ্ডু। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পোষ্য কোটার বিষয়ে তিনি তেমন ওয়াকিবহাল নন। তবে সাধারণত ডিউটি করতে গিয়ে কেউ মারা গেলে তাঁর চাকরি পাওয়ার মতো উপযুক্ত ছেলেমেয়ে থাকলে যেন চাকরি দেওয়া হয়, সেই নির্দেশ দেন।
পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম পুলিশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের দাবি জানান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোন হাসপাতালে কত রোগী যায়, তার একটা জরিপ করেছিলাম। সেই অনুপাতে এর আগে শয্যাসংখ্যা বাড়ানো হয়। অহেতুক শয্যা বাড়ালেই তো হবে না, সেগুলো বিবেচনা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা আধুনিক করতে যা লাগে, আমরা করব। সরকারি বা অন্য হাসপাতালে পুলিশের জন্য জরুরি প্রয়োজনে যেন আলাদা সিট থাকে, সেটার ব্যবস্থা আমরা করব।’
এএসপি তাপস চন্দ্র ঘোষ বলেন, পুলিশ জীবন বাজি রেখে গণতন্ত্র অব্যাহত রেখেছে এবং রাখবে।
কুমিল্লা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত এসপি তানভীর সালেহিন ইমন নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিলের দাবি তুলে বলেন, ‘পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন কিংবা মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করার বিধান রেখে একটি বেসরকারি বিলের মাধ্যমে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন নামে একটি আইন জারি করা হয়েছে। আইনটিতে নির্যাতনের সংজ্ঞায় মানসিক কষ্টকে নির্যাতন বলা হলেও তা নির্ণয়ের কোনো মানদণ্ড না থাকায় যে কেউ এ আইনে পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার সুযোগ পাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে যেকোনো নির্যাতনের অভিযোগে তদন্ত ছাড়াই আবশ্যিকভাবে এ আইনের অধীনে তদন্তকারী কর্মকর্তা, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বা কমান্ডিং অফিসারের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো মামলা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এই আইনে একাধিক থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধিসহ দেশে প্রচলিত অন্যান্য আইন যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দায়িত্ব পালনে রক্ষাকবচ (সেফ গার্ড) হচ্ছে, সেখানে এ আইন তাঁদের (আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য) অধিকারকে খর্ব করছে। মানসিক নির্যাতনের অজুহাতে যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করার সুযোগ থাকে, তবে তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পুলিশ নিরুৎসাহিত হবে।’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আইনের বিষয়ে একটা কথা বলি। এটা পার্লামেন্টে বেসরকারি বিল আকারে যিনি (সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি) নিয়ে এসেছেন, তিনি নিজে একজন নির্যাতিত। বিএনপির আমলে তাঁকে অকথ্য অত্যাচার করা হয়। তারপর তিনি পার্লামেন্টে আসার পর এটা নিয়ে আসেন এবং পাস হয়ে যায়। যেটা পাস হয়ে গেছে, সেটা বাতিল করতে যাওয়া ঠিক হবে কি না, জানি না। তবে এটাও ঠিক যে মিথ্যা মামলা যদি কেউ করে এবং এটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে ওই আইনেই বিধান রয়েছে যে তাঁকেও (বাদীকে) ওই আইনে একই রকম শাস্তি দেওয়া যায়।’
আদালতের এই রায়ের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু আদালত দিয়ে দিয়েছে, আমরা কিছু বলতে পারছি না। কিন্তু এ রায়টা তাঁরা কেন দিলেন জানি না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয়, পুলিশ বাহিনী তাদের দায়িত্বশীলতার বিষয়ে খুবই সচেতন। শুধু পুলিশ কেন, সব ক্ষেত্রেই যেখানে পেশাগত ভুলের সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে জবাবদিহি থাকতে হবে। বিশেষ করে যারা পাবলিক সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত, এ ধরনের কোনো কাজই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। আর এই আইনটি একটি সুবিবেচনাপ্রসূত আইন। আমার মনে হয়, এটি পুলিশ বাহিনীকে আরও দায়িত্বশীল হতে সাহায্য করবে।’
যোগাযোগ করা হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ঠিক জানি না কী বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়েছে। তবে চট করে তো একটা আইন বাতিল করা যায় না। এর একটা প্রক্রিয়া রয়েছে। আর ৫৪ ও ১৬৭ ধারার বিষয়ে মহামান্য আদালত যে রায় দিয়েছেন, সেটা একটা যুগান্তকারী রায় হিসেবে গণ্য। এই আইনের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কাঙ্ক্ষিত নয়।’
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১০ নভেম্বর ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) এবং হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ১৬৭ ধারা প্রয়োগ নিয়ে ৩৯৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য ১০ দফা নির্দেশনা এবং হাকিম, বিচারক ও ট্রাইব্যুনালের জন্য ৯ দফা নির্দেশনা রয়েছে। সুত্র, প্রথম আলো