বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

‘চাঁদাবাজদের’ বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে হকারদের প্রশ্ন

SONALISOMOY.COM
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭
news-image

নিজস্ব প্রতিবেদক:

গুলিস্তান ও মতিঝিল এলাকার ফুটপাত ও সড়কে অবৈধ দোকান বসিয়ে তা থেকে ‘চাঁদাবাজির’ অভিযোগে ৭২ জনের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের করা মামলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হকাররা।
তারা বলছেন, হকার্স পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ হকার্স লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এম এ কাশেমের ‘সরবাহ করা তথ‌্যে’ এ মামলা হয়েছে, অথচ তার বিরুদ্ধেই রয়েছে চাঁদাবাজির অভিযোগ।

আসামির তালিকায় বেশ কয়েকজন ‘লাইনম্যান’ও হকারের নাম এলেও তারা চাঁদাবাজির গোড়ার লোক নন বলে অন‌্য হকারদের ভাষ‌্য।

মামলার আসামি হকার্স সমন্বয় পরিষদের সমন্বয়ক আবুল হোসাইন বলেন, সিটি করপোরেশর হকার উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে সম্প্রতি হকারদের সংগঠনগুলোর মোর্চা বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনে মতবিরোধ দেখা দেয়। ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাশেম মেয়রের পক্ষ নিলে অন‌্য কয়েকজন এর বিরোধিতা করেন।

“এ কারণে কাশেম অন্যদের নাম চাঁদাবাজদের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। আমরা হকারদের পক্ষ নিয়েছি। এই হচ্ছে দ্বন্দ্ব।”

যানবাহন ও পথচারী চলাচল নির্বিঘ্ন করতে রাজধানীর গুলিস্তান-মতিঝিলের ফুটপাত ও সড়কে হকার বসা বন্ধ করতে মধ্য জানুয়ারিতে অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদে অভিযান চালায় ডিএসসিসি।

এর প্রতিবাদ ও পুনর্বাসনের দাবিতে সেই থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন উচ্ছেদ হওয়া হকাররা। ডিএসসিসি মেয়রের বিরুদ্ধে নালিশ করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছেন তারা।

হকারদের সেই আন্দোলন চলার মধ্যে বৃহস্পতিবার তিনটি মামলা করে সিটি করপোরেশন। আসামির মধ‌্যে আরিফ ছাড়াও বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের উপদেষ্টা সেকেন্দার হায়াত, আবুল হাসেম কবির, মুরিসকুল ইসলাম শিমুল, শফিকুর রহমান বাবুল, মঞ্জুর মঈন, ছিন্নমূল হকার্স লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন মজুমদার, ছিন্নমূল হকার সমিতির নেতা খায়রুল বাশার ও রফিকুল ইসলামের নাম রয়েছে।

আরিফ বলেন, “চাঁদাবাজি যদি আমরা করে থাকি, সেই দোষে তো আবুল কাশেমও দুষ্ট। সে তো আমাদের ফেডারেশনের সভাপতি। সে তো এটা থেকে মুক্ত হতে পারে না। যে নিজে চাঁদাবাজ তার দেওয়া তথ্যে সিটি করপোরেশন মামলা করে কীভাবে?”

হকারদের এই অংশের অভিযোগ, মোহাম্মদ হানিফ মেয়র থাকার সময় ওসমানী উদ্যানের জায়গায় হকারদের বসার জন‌্য হকার্স ফেডারেশন থেকে কার্ড দেওয়া হয়। ওই কার্ডের জন‌্য আবুল কাশেম হকারদের কাছ থেকে ২০০ টাকা করে আদায় করেন।

এভাবে গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টনসহ আশপাশের এলাকায় হকার বসিয়ে কয়েক লাখ টাকা তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন রমনা ভবন এলাকার হকার মোহাম্মদ আবদুল আলী দেওয়ান।

‘টাকার বিনিময়ে পাওয়া’ নিজের কার্ডটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “কাশেম তো আমার কাছ থেইকাই দুইশ টাকা নিছে কার্ড দিয়া। এইভাবে এই এলাকার সব হকারের কাছ থেইকা টাকা নিসে। এখন সে আবার সিটি করপোরেশনে গিয়া হকারগো বিরুদ্ধে দাঁড়াইছে।”

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে আবুল কাশেমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তার কার্যালয়ে গেলে সেটি তালাবন্ধ দেখা যায়।

ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে বৃহস্পতিবার মতিঝিল, পল্টন ও শাহবাগ থানায় মামলা তিনটি দায়ের করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সহকারী সম্পত্তি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সামছুল আলম।

হকারদের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে  তিনি বলেন, মামলাগুলো করা হয়েছে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ সিদ্ধান্তে।

“এ মামলার সব কাগজপত্র আইন শাখা তৈরি করে দিয়েছে। সম্পত্তি বিভাগের পক্ষে আমি কেবল এজাহারে সই করেছি।”

হকার্স লীগ নেতা এম এ কাশেমের কাছ থেকে তথ‌্য নিয়ে মামলা করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান সামছুল আলম।

যার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে, তার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে মামলা করা যৌক্তিক কি না- এমন প্রশ্নে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আমাদের কাছে তার বিরুদ্ধে কোনো তথ্য নেই, কেউ আমাদের কাছে অভিযোগও করেনি।”

মামলা করার আগে সিটি করপোরেশন নিজে অনুসন্ধান ও যাচাই করেছিল কি-না এমন প্রশ্নে কামরুল বলেন, “আপনি রোববার আসেন। আমি কথা বলব।”

বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত গুলিস্তান, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, জিরো পয়েন্ট, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকা ঘুরে হকারদের সঙ্গে কথা বলার পর মামলার আসামিদের মধ‌্যে বেশ কয়েকজনকে চাঁদাবাজ হিসেবে চিহ্নিত করেন সেসব এলাকার হকাররা।

এর মধ‌্যে খলিল, বুড়া সালাম, সরদার সালাম, আক্তার, জাহাঙ্গীর, কালা নবী, আব্দুর রব, হাসান, শহীদ, খোরশেদ ওরফে বড় মিয়া, বিমল বাবু, শওকত, হাবিব, ভোলা ও কানা সিরাজের নাম রয়েছে।

তবে আসামির তালিকায় থাকা কয়েকজনের পরিচয় হকারারও জানাতে পারেননি।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাহবাগ থানার মামলার সাত আসামির মধ্যে শাহজাহান ওরফে লম্বু শাহাজাহান, বাবুল, হিন্দু শাহীন, আইয়ুব লাইনম্যান। অর্থাৎ, তারা মূল চাঁদাবাজদের পক্ষে দোকানে দোকানে ঘুরে ‘তোলা নেন’। আর মানিক, ইমরান ও দোলন ফুটপাতের দোকানদার।

মানিক ওসমানী উদ্যানের দক্ষিণপাশে ফুটপাতে চুল কাটেন। আর ইমরান ও দোলন পুরোনো মোবাইলের পার্টস বিক্রি করেন। তাদের চাঁদাবাজ হিসেবে মানতে পারেননি অন‌্য হকাররা।

পল্টন থানার মামলায় খোরশেদ ওরফে বড় মিয়া ও কালামের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তারা গুলিস্তান হল মার্কেটের উত্তর-পশ্চিম পাশের ফুটপাতে চাঁদাবাজি করেন। ওই এলাকার হকাররা বলছেন, খোরশেদ লাইনম্যান হলেও কালাম চাঁদাবাজ নন।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফুটপাতে লুঙ্গি সাজিয়ে বসছিলেন কালাম। তার ভালো নাম আবুল কালাম আজাদ। চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

“আমি এই ফুটে ব্যবসা করি। চাঁদাবাজি করুম ক্যান। কয়েকদিন আগে আমার কাছে কাশু (আবুল কাশেম) কিছু টাকা চাইছিল। আমি দেই নাই। কয়দিন মিছিলেও গেছিলাম। এই কারণে মামলায় নাম দিছে মনে অয়।”

রমনা ভবনের পশ্চিম পাশের ফুটপাতের মনির ও শফিকের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হলেও তারা চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত নন বলে সেখানকার একাধিক হকারের ভাষ‌্য।

ভাসানি হকি স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের ফুটপাতের চাঁদাবাজ হিসেবে মামলায় নাম দেওয়া হয়েছে মো. আলী মিয়ার। সেখানে ওই নামে কাউকে চেনেন না বলে কয়েকজন হকার জানান। আর রিপন নামে এক হকার বলেন, আলী প্রায় ছয় মাস ওই এলাকাতেই যাননি।

“আলী ভাই আহে নাই ছয় মাসের বেশি হইছে। আর আমরা এই ফুটের হকাররা কাউরে চান্দা দেই না।”

ছিন্নমূল হকার্স সমিতির সভাপতি কামাল সিদ্দিকীর নামেও চাঁদাবাজির মামলা করা হয়েছে। তবে তিনি চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত নন বলে দাবি করেন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ফুটপাতের একাধিক হকার।

আবদুর রহিম নামের একজন বলেন, “কামাল ভাই চান্দা খায় না। উনি আমাদের বিপদে আপদে সাহায্য করে। তয় রব টাকা নেয়।”

বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেইটের ফুটপাতের জাহাঙ্গীর ও নসুকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। সেখানকার হকাররা বলছেন, লাইনম্যানদের সঙ্গে জাহাঙ্গীর ও নসুর নাম দিয়ে দেওয়া হয়েছে। নসু ফুটপাতে ব্যবসা করেন, আর জাহাঙ্গীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গত দুই বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে আছেন।

জাহাঙ্গীরের ভাই জুলহাসও ফুটপাতে ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, “ভাইয়ের তো দুইবার স্ট্রোক হইছে। এহন তো আসেই না। তার নাম কীভাবে মামলায় দিল বুঝলাম না।”

বায়তুল মোকাররমে মিনারের পাশের ফুটপাতের হকার আবদুল কাদির দাবি করেন, “নসু ভাই কোনোভাবেই হকার না। তার মত ভালো মানুষ পাওয়া মুশকিল।”

এ মামলার আসামি বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের উপদেষ্টা মঞ্জুর মঈন বলেন, তাদের আন্দোলন ঠেকাতে সিটি করপোরেশন ‘মামলার কৌশল’ নিয়েছে।

“এটা খুবই ঘৃণ্য কৌশল। ফুটপাতের চাঁদাবাজ লাইনম্যানদের সঙ্গে হকার্স ইউনিয়নের নেতাদের নাম জুড়ে দেওয়া…. এই আন্দোলনে লাইনম্যানদের ওপর নির্ভর করে হয় নাই, আমাদের আন্দোলন সাধারণ হকারদের সঙ্গে নিয়ে। মামলা করে আন্দোলন ঠেকানো যাবে না।”

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন মামলা হওয়ার পর বৃস্পতিবার বিকালে বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় একটি মহল উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করতে চাইছে।

“যাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। তারা এটাকে ব্যাহত করতে চাইছে। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে হকার নামধারী লোকদের টাকা দিয়ে এনে মিছিল করাচ্ছে। এটাকে ব্যাহত করার চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক নামধারী লোকও রয়েছে। সুত্র, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম