শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ঢামেকে ফ্রি বেডে লাখ টাকার বাণিজ্য!

SONALISOMOY.COM
আগস্ট ৬, ২০১৮
news-image

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে পদে পদে গুনতে হয় বকশিশের নামে টাকা। বকশিশ না দিলে কাউকে খুশিও করা যায় না আবার কোনো কাজও আদায় করা যায় না। প্রতি বিভাগের প্রতি ওয়ার্ড ঘিরে রয়েছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট চক্র। তাদের ছাড়া সেবা পাওয়া দুষ্কর। হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়, পরিচ্ছন্নকর্মী, স্পেশাল বয়, আয়া রোগী জিম্মি করে টাকা আদায় করে। অভিযোগ আছে রোগীদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে আদায়কৃত টাকার ভাগ পান ওয়ার্ড মাস্টাররা।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে রোগীদের জন্য বরাদ্দ ফ্রি বেড পেতে টাকা দিতে হয়। ওয়ার্ডবয়, ট্রলিম্যান ও আয়াদের টাকা দিলেই তবেই বেড পান রোগীরা। একটি বেড পেতে গুনতে হয় ৩০০-৫০০ টাকা। রোগীর আত্মীয়দের অভিযোগ, অর্থ না দিলে এখানে বেড পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে হাসপাতাল প্রশাসন বলছে, প্রয়োজনের তুলনায় বেড কম থাকায় এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এ ধরনের দুর্নীতির পেছনে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর শনিরআখড়া থেকে অসুস্থ মা’কে নিয়ে এসে ঢামেক হাসপাতালের ৮০১ নম্বর ওয়ার্ডে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করেছেন সুমনা আক্তার (২৩)। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জ্বর, বমি আর দুর্বলতা নিয়ে মাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরীক্ষা করার পর চিকিৎসক এখানে তাকে ভর্তির নির্দেশ দেন। এসময় আমরা মা’কে বেডে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এখানকার ওয়ার্ডে দায়িত্বে থাকা লোকজন জানান, টাকা না দিলে বেড পাওয়া যাবে না।’

সুমনা বলেন, ‘আমার মা তখন ট্রলিতে ছিল। মায়ের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। যে ট্রলিতে এনেছিল সেটি খালি করার জন্য বারবার তারা তাগাদা দিচ্ছিল, তাই বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকা দিয়ে এই বেড ভাড়া নিয়েছি। আমি ট্রলিম্যানের হাতে টাকা দিয়েছি। সে বলেছে, এই টাকা ওয়ার্ডবয়কে দিতে হবে।’

পটুয়াখালী থেকে এসে ঢামেকে ভর্তি হয়েছেন হুনেফা বেগম (২৫)। তিনি বলেন, ‘এখানে চিকিৎসা খরচ কম কিন্তু অন্য খরচ বেশি। এখানে ১০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে রোগী দেখা যায়। আর ১৫ টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া যায়, কিন্তু ট্রলি দিয়ে আমাকে আনতেই ট্রলিম্যান ৩০০ টাকা নিয়েছেন। আবার বেড পেতে আমার স্বামী ওয়ার্ডবয়কে ৩০০ টাকা দিয়েছেন। তবে এখানে ওষুধ ও খাবার ফ্রি পাচ্ছি।’

সরেজমিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৮০১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়,নতুন রোগী ভর্তির পর বেডে নিয়ে আসছেন তার আত্মীয়রা। নিজেকে ওয়ার্ডবয় পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি রোগীর আত্মীয়দের বলেন, ‘এখন একটা মাত্র বেড খালি আছে। যদি নিতে চান ৩০০ টাকা দিতে হবে। পরে, অন্য রোগী নিয়ে নিলে বেড পাবেন না।’ এসময় রোগীর আত্মীয় তাকে ৩০০ টাকা দেন। পরপর কয়েকজন রোগী এলে তাদের প্রত্যেককে একই কথা বলে অর্থ নিতে দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, ‘এখানকার সিস্টেম এরকমই। আমরা চিকিৎসকরা বেডের ব্যাপারে কিছুই করতে পারি না। রোগীরা নিজেরা বিভিন্ন উপায়ে বেড দখল করেন। অনেক সময় রোগীরা নির্দিষ্ট বেড পান না। একজন রোগী চলে গেলে রোগীর আত্মীয়রা নিজেরা পরামর্শ করে বেড পরিবর্তন ও দখল করেন।’ তবে, অর্থ নেওয়ার ব্যাপারে কোনও কথা বলতে রাজি হননি চিকিৎসকরা।

এ প্রসঙ্গে আবুল হোসেন নামে একজন ওয়ার্ডমাস্টার বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেয় যে,তার কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিই।’

বেড নিয়ে দুর্নীতি প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমার এখানে দুই হাজার ৬০০ রোগীর জায়গায় থাকেন চার হাজার রোগী। বেডের ব্যবস্থা আছে মাত্র এক হাজার ৬০০ রোগীর। যার কারণে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।’

ওইখানে যারা থাকেন তাদেরকে বেডের অর্থ দেওয়া প্রসঙ্গে হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘একজন রোগী বাইরে থেকে এসে বলছেন বেড পাচ্ছেন না। সে কেন অভিযোগ করছেন না। সে চিকিৎসক বা নার্সকে বলুক। বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে। তবে কোথায় এমন ঘটনা ঘটছে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলুন। তাহলে আমরা সেটা তদন্ত করবো।’

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে এই লোকগুলো দালালি করছে। দেশের সবখানেই দালাল আছে। কোর্টে আছে, হাসপাতালে আছে। এই দালালরা এই ধরনের অর্থ নিয়ে থাকে। যখন কোনও রোগীর কাছে এভাবে অর্থ চাইছে সে যদি আনসারকে গিয়ে বলে তাহলে সে প্রতিকার পেতে পারে। মাঝে মাঝে আমাদের কাছে এই ধরনের অভিযোগ আসে না তা না। আমরা চেষ্টা করি কোনও অভিযোগ পেলে সমাধান করতে। তবে, রোগীর অ্যাটেনডেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে জোর দিলেই রোগীর পক্ষ থেকে হাহাকার শুরু হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের পিছপা হতে হয়।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন মোবাইলে বলেন, ‘হাসপাতাল সুস্থভাবে পরিচালনা করতে ওইখানে তো আমাদের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া আছে। একজন উপ-পরিচালক দিয়েছি। তিনজন সহকারী পরিচালক দিয়েছি। পাঁচজন লোক ওখানে আছেন। তারপর প্রত্যেক বিভাগে একজন করে বিভাগীয় প্রধান আছেন, এরা সবাই সরকারি বেতনভোগী কর্মকর্তা। তাদেরই তো দায়িত্ব এই বিষয়গুলো দেখাশোনা করা। ভালো সার্ভিস দেওয়া। আমরা মাঝে মধ্যে বিষয়গুলোকে দেখি।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের আমি একজন কর্মকর্তা। সারাদেশে অনেকগুলো সরকারি হাসপাতাল আছে। প্রায় ২২ হাজার বেসকারি হাসপাতাল আছে। যদি কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে যে, কোনও রোগীকে টাকা দিতে হয়েছে তাহলে আমি অ্যাকশন নিতে পারি। যেহেতু পরিচালক সেখানে আছেন, সেখানে সুষ্ঠুভাবে চলছে কিনা, স্টাফরা ঠিকমতো কাজ করছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব পরিচালকের।’

হেলথ রাইটস মুভমেন্টের প্রেসিডেন্ট ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘এটা একটা দুর্নীতি। যারা বাইরে থেকে আসে হেলপ করার কেউ থাকেন না। তারা ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বেড বণ্ঠনে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে এমনটি ঘটত না। এখানে বেডের ঘাটতি আছে। তাই রোগীরা টাকা দিয়ে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা মূলত অব্যবস্থাপনারই একটা অংশ। এটা পরিবর্তনে আমাদের আরও হাসপাতাল ও বেড বাড়াতে হবে।’