শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

মাইক্রো ড্রাইভার থেকে কোটিপতি মাদক সম্রাট মামুন

SONALISOMOY.COM
মে ১৩, ২০১৯
news-image

সোনালী সময় প্রতিনিধি: ভয়ঙ্কর এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম আব্দুল্লাহ আল মামুন ওরফে ইয়াবা মামুন। ষষ্ঠ শ্রেণি পাশ মাইক্রো ড্রাইভার থেকে বিএনপির রাজনীতিতে হাতেখড়ি। বর্তমানে তিনি স্বঘোষিত যুবলীগ নেতা হিসেবে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার সাম্রাজ্য গড়াসহ চাঁদাবাজি, জমি দখল করে বিপুল অর্থ বিত্তের অধিকারী।

তার মাদক সাম্রাজ্য রক্ষায় ৪০/৫০ জনের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে টু-শব্দ করারও উপায় নেই। এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও প্রতি মূহুর্তে তাকে নিয়ে আতঙ্কে দিন যাপন করে। ইতোমধ্যেই মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলায় বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর আহত করাসহ অসংখ্য বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় মামুন বাহিনীর মারপিটের শিকার চার ব্যক্তি বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এলাকার অনুসন্ধানে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।

শূণ্য থেকে বহু কোটিপতি হয়েছেন ইয়াবা মামুন। পাবনা পৌর এলাকার নূরপুর বাইপাস সড়কে রয়েছে তার বিলাসবহুল ২য় তলা বাড়ি। তার গাড়ি বহরে রয়েছে একটি বিলাসবহুল কার, প্রাডো জিপ, একটি কারসহ ২০/২৫ টি মোটরসাইকেল। তার চালচলনে তিনি বিশাল নেতা তাই যেন বোঝাতে চান। তিনি বাড়ি থেকে বেরোলেই আগপিছু মোটরসাইকেল বহরের মাঝখানে বিলাসবহুল গাড়িতে বসে থাকতে দেখা যায়। তার সাথে সার্বক্ষণিক ১০ জন দেহরক্ষী দায়িত্ব পালন করে।

এসব নিরাপত্তারক্ষীদের আড়াই লাখ টাকা মাসিক বেতন গুনতে হয় ইয়াবা মামুনকে। পারিবারিক অনুসন্ধানে জানা যায় তার পিতার নাম হুমায়ূন ড্রাইভার, মাতা- খোদেজা বেওয়া। খোদেজার তৃতীয় স্বামীর ঘরে জন্ম নেয় ইয়াবা মামুন। খোদেজার প্রথম স্বামী নাসিম মোল্লা নুরপুরের শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। কুখ্যাত এ রাজাকারকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে।

মামুন পাবনা আর.এম.একাডেমী স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে মাইক্রো ড্রাইভার হিসেবে সৌদিতে পাড়ি জমায়। বিএনপি আমলে দেশে ফিরে এসে নিজ ভাই সুদে খলিলের হাত ধরে বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর নূরপুরের প্রভাবশালী পরিবারের এক সন্তানকে প্রকাশ্যে মারপিট করে মামুন প্রথমে প্রচারে আসে। আওয়ামী লীগ আমলে সে স্বঘোষিত সদর থানা যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা বনে যান।

তার বিরুদ্ধে রড বোঝাই ট্রাক ডাকাতি, শালগাড়িয়ায় প্রভাবশালী ২টি বাড়িতে বড় ধরনের ডাকাতি, ব্র্যাক অফিসে ১৮ লাখ টাকা ডাকাতির ঘটনায় নাম আসলেও থানায় কোন মামলা হয়নি। তার দুলাভাই ডিবি পুলিশের প্রভাবশালী এস. আই (বর্তমানে অবসর) হান্নান সরকারকে ব্যবহার করে তিনি একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন। দুলাভাইয়ের ক্ষমতার জোরে ইয়াবা মামুন ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার সম্রাট বনে যান। তিনি পাবনাসহ কুষ্টিয়া, নাটোর, সিরাজগঞ্জ জেলায় মাদক ব্যবসার জাল বিস্তার করে। এ চার জেলার মাদক ব্যবসার পাইকারী মহাজন হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে অসংখ্য মাদক কারবারীরা তার কাছে এসে ভিড় জমায়। শুধু তাই নয় তার বিরুদ্ধে ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরিরও অভিযোগ ওঠে।

মিয়ানমার থেকে প্রায়ই তার বাড়িতে লোকজন আসার খবরও এলাকার সবাই জানেন। বাইপাস মোড়ে এক শিল্পপতির গোডাউনে ইয়াবা কারখানা গড়ে তোলে ইয়াবা মামুন। এ ঘটনা জানাজানি হলে কারখানাটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। মামুন পাবনার ওই মহিলা শিল্পপতির ডান হাত বনে যান। ওই শিল্পপতি তাকে দিয়ে অনেক অনৈতিক কাজ করেছেন বলে পাবনায় জনশ্রূতি রয়েছে। ইয়াবা মামুন তার মাদক ব্যবসা ঠিক রাখতে ৪০/৫০ জনের সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করা হয়।

আওয়ামী লীগের ত্যাগি নেতাকর্মীদের কাছে মামুন মানেই এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। অসংখ্য আওয়ামী লীগ নেতা তার হামলার শিকার হয়েছে। নূরপুরের বাসিন্দা জেলা কৃষকলীগের প্রচার সম্পাদক আঙ্গুর মামুনের মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করলে তার শরীরের ১৪টি জায়গায় কুপিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার একটি হাত এখনও অসাড় রয়েছে। নূরপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ইবরা, রাজ্জাক মেম্বার, অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান, আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক কমিশনার ইকরাম আলী, থানা আওয়ামী লীগ নেতা পাঞ্জাব মামুন বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছে।

মালিগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি হামদু বিশ্বাসের বাড়িঘর ভাঙচুর শেষে পুড়িয়ে দেয় মামুন বাহিনী। মালিগাছা ইউনিয়নের রামানন্দপুর আওয়ামীলীগ নেতা সবুজ, আওয়ামী লীগ নেতা পাঞ্জাব, ইজাই, হানিফ আলী, খোকনসহ ২৫টি বাড়িতে একদিনে আক্রমণ চালিয়ে মামুন বাহিনী বাড়িঘর লুটপাটসহ আগুন ধরিয়ে দেয়। তার আক্রমণে শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই।

মামুন বাহিনীর হামলায় শহরের রূপকথা রোডের একটি চায়নিজ রেঁস্তরা (‘স্বাগতম’) ভাংচুর করা হয়। অচিন্ত্য ঘোষের বাড়িতে হামলা এবং কসাই পট্টির শিশুদের স্কুলে হামলা করে শিক্ষককে মারপিট করে মামুন বাহিনী। সব কিছুই ধামা-চাপা পড়ে পুলিশের কারসাজিতে! দীর্ঘদিন যাবৎ পুলিশের দায়িত্বহীন আচরণ এবং আস্কারায় মামুন নির্বিঘ্নে মাদক ব্যবসাসহ নানা অসামাজিক কাজ করে চলেছে। পুলিশ এখন তাদের অপকর্ম ঢাকার জন্যই মামুনকে ‘সেফ’ করার কাজে ব্যস্ত।

রামানন্দপুর গ্রামের আকুল, আলম ও নূরু মোল্লার জায়গা দখল করে ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে মামুন। একই গ্রামের ফ্যোনে মোল্লার ৩ বিঘা জমি দখল করে নেয় মামুন। মামুন বাহিনী বিলভাদুরিয়া গ্রামের ওসমান, বক্কার ও ইসমাইলকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। বিদেশ ফেরত ইসমাইলের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে মামুন। এ ঘটনায় সে অস্বীকৃতি জানালে তাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ভুগে ভুগে তিনি মারা যান। মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করায় ওসমান ও বক্কারকেও মামুন বাহিনীর হামলার শিকার হতে হয়। চিকিৎসার অভাবে এ দুইজনও মারা যান।

বর্তমানে প্রতি রাতেই মামুন বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। ইয়াবা মামুন সদর উপজেলা মালিগাছা ইউনিয়ন, মালঞ্চি ইউনিয়ন, গয়েশপুর ইউনিয়ন, আটঘরিয়া উপজেলা, দেবোত্তর ও ফৈলজানা ইউনিয়নসহ শহরের আশপাশে গ্রাম গুলি তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। মামুনের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে যারা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তাদেরকেই তার দুলাভাইয়ের সহায়তায় ডিবি পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিলভেদুরিয়া গ্রামের শিমুল, নূরপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিনের ছেলে সুজনকে অস্ত্র দিয়ে ডিবির হাতে ধরে দেয়া হয়।

আরো অভিযোগ রয়েছে ডিবির এস.আই দুলাভাই হান্নান সরকার যেসব অস্ত্র বাইরে থেকে উদ্ধার করতো তা মামুনকে বিক্রি করার জন্য দেয়া হতো। মামুন যাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতো তাদেরকেই আবার ডিবি পুলিশ দিয়ে ধরে এনে বিপুল অঙ্কের টাকা আদায় করা হতো। তার দুলাভাই হান্নান সরকার মামুনের বাড়ির সাথেই আলিশান ২য় তলা বাড়ি করেছেন। চাঁপাইতে তার জমিজমাসহ অনেক সম্পদ রয়েছে। দুলাভাই ডিবি দারোগা হওয়ার সুবাদে পুলিশ প্রশাসনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে মামুন। যার কারণে সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান হলেও নির্বিঘ্নে মাদকব্যবসা পরিচালনা করছে ইয়াবা মামুন। ইয়াবা মামুনের ভাই সুদে খলিলও মাদক ব্যবসায় বহু কোটিপতি। আর খলিলের ছেলে মেহেদী হাসান বিদ্যুৎ মামুনের সেনাপতির দায়িত্ব পালন করছে।

ইয়াবা মামুনের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার সংবাদ পরিবেশন করায় দৈনিক সংবাদ এর স্টাফ রিপোর্টার হাবিবুর রহমান স্বপনকে গত অক্টোবর হেলমেট বাহিনী দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙ্গে ফেলে।

ইয়াবা মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সাংবাদিক সুবর্ণা আক্তার নদী হত্যার রহস্যও উদঘাটন সম্ভব বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করলেও পুলিশ কর্ণপাত করছে না। নদীর সাথে মামুনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নদী অন্যদের দিকে ঝুঁকে পড়লে এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে টানাপোড়নের জের ধরে নদীকে হত্যা করা হয় বলে বিভিন্ন মহল আশঙ্কা করছেন। নদী হত্যার ব্যাপারেও পুলিশের তদন্ত ঢিলে-ঢালা। সবকিছু যেন পাবনা পুলিশের কাছে গা-সওয়া ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে নতুন পুলিশ সুপার পাবনায় যোগদানের পর পাবনার আইন-শৃঙ্খলার চরম অবণতি হয়েছে। পাবনাবাসী শন্তিতে বসবাস করতে চায়। এর জন্য সরকারের সুদৃষ্টি আশা করে।