শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

নেপথ্যে কোটি টাকা আত্মসাত
বাগমারায় নিজ দলীয় কোন্দলে খুন হন মৎস চাষী আনিছুর

SONALISOMOY.COM
এপ্রিল ২৩, ২০১৮
news-image

বাগমারা প্রতিনিধি: বাগামারার জোকাবিলে মৎস চাষী অনিছুর হত্যার জট খুলতে শুরু করেছে। জোকাবিলে মাছ চাষ ও বিলের প্রায় দশ কোটি টাকা আত্মসাত ও নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়াকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামীলীগের বিবাদমান দুটি গ্রুপের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারন করলে প্রতিপক্ষের লোকজন ভড়াটে খুনিকে দিয়ে পরিকল্পিত ভাবে খুন করা হয় আনিছুরকে।

লোমহর্ষক এই হত্যা কান্ডকে ঘিরে কোটি কোটি টাকার লেনদেন জড়িত থাকায় এর রহস্য উদঘাটনে মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।

তারা দিন রাত জোকা বিল সংলগ্ন ৫/৬ টি গ্রামে সরেজমিন অনুসন্ধান করে চলেছেন খুনের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের এবং গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রকৃত খুনিকে। আধুনিক মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইতিমধ্যে এই হত্যা কান্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও হত্যাকারীদের গ্রেফতারে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বলে ওই সব গেয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি সূত্রে জানা গেছে।

স্থানীয় গ্রামবাসী ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়, জোকাবিলে মাছ চাষকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামীলীগের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিনের । প্রায় বাইশ হাজার বিঘা আয়তনের এই জোকা বিলে প্রতিবছর মাছ চাষ করে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বেশি আয় হয়। শুরুতে বিল এলাকার ৫/৬ টি গ্রামের প্রায় ৮/৯শ সদস্য নিয়ে জোকাবিল মৎস সমবায় সমিতি নামে একটি কার্যক্রম শুরু করা হয়। আনিছুর শুরুকে ওই সমিতির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি জামায়াতের রাজনীতির সাথেও সক্রিয় জড়িত ছিলেন। সে সময় বিলের নিয়ন্ত্রন ছিল সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জনাব আলীর হাতে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী রাজনীতির সাথে ওতপ্রোত জড়িত। তখন স্থানীয় একটি আওয়ামী পক্ষ জনাব আলী ও তার ছেলে উজ্জল বিরোধী প্রচারনায় নেমে পড়ে। এর নেপথ্যে ইন্দন দেয়া শুরু করেন আনিছুর নিজেই। তিনি বিলের রাজনীতিতে জড়িয়ে সমিতি কুক্ষিগত করার জন্য ভোল পাল্টিয়ে আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমেই তিনি সমিতির কোষাধ্যক্ষ থেকে সভাপতির পদটি কুক্ষিগত করেন। সভাপতির পদ দখল করে আনিছুর সমিতিতে তার বিরোধী পক্ষ হিসেব পরিচিত ব্যক্তিকে একে একে বাদ দেওয়া শুরু করেন। এভাবে তার বিরাগ ভাজন ব্যক্তিকে বাদ দিতে দিতে আনিছুর সমিতির সদস্য সংখ্যা নয়শ থেকে দেড়শ তে নামিয়ে আনেন।

সুত্র মতে, এভাবে বেআইনী প্রক্রিয়ায় সমিতির সদস্য ছাঁটাই করা হলেও কোন সদস্যকে তার অংশের লভ্যাংশ এমনকি শেয়ারের একটি টাকাও ফেরত দেওয়া হয়নি। অথচ সকল খরচ বাদে প্রতি বছর জোকাবিলে মাছ চাষের লভ্যাংশ আসে পাঁচ কোটি টাকারও অধিক। এভাবে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা অবৈধ আয় থেকে আনিছুর এলাকায় একটি অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনী লালন পালন শুরু করেন। বিল এলাকার সাধারন জনগন আনিছুরের জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। সমিতি থেকে বাদ পড়া ৬/৭ জন সদস্যরা জানান, আনিছুর ছিলেন খুবই ধুরন্ধর ও কৌশলী প্রকৃতির মানুষ। তিনি জানতেন অন্যায় পস্থায় বিলটির দখল ধরে রাখতে হলে টাকার প্রয়োজন। তাই তিনি তার অনুসারী সদস্যদের বুঝিয়ে প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও স্থানীয় বিরোধী পক্ষ ও তাদের নেতা কর্মী সহ বিভিন্ন শক্তিকে ম্যানেজ করতে ঘুষ বিতরণ শুরু করেন । এ জন্য তিনি প্রায় এক কোটি টাকার একটি জরুরী ফান্ড গঠন করেন।

জানা গেছে তিনি জীবিত থাকা কালীন এই জরুরী ফান্ড থেকে প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা খরচও করে ফেললেও তিনি শেষ রক্ষা পাননি। আনিছুরের নিজ দলের মধ্যে একটি বিরোধী পক্ষ ছিল। তারাও চাইছিল আনিছুরকে ঘায়েল করতে।

সুত্র মতে, আনিছুর তাদেরকে সে সব সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা বলে সমিতির বিভিন্ন পদে স্থান দেওয়া হলেও মূলত আনিছুরই ছিল এর একক নিয়ন্ত্রক। টাকা পয়সার লেনদেন সে এক হাতেই নিয়ন্ত্রন করত। ওই সমস্ত সদস্যকে দলে ভিড়িয়ে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজের আখের গোছালেও তাদেরকে সম্পূর্ণ বি ত করায় আনিছুরের নিজ দলেই তার প্রতিপক্ষ দাড়িঁয়ে যায়। এই পক্ষেরই প্রত্যক্ষ ইন্ধনে এবং নিরব ভুমিকার কারণেই সেদিন আনিছুরকে ভাড়াটে খুনিরা প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে চলে গেলেও তাদের প্রতিরোধে কেউ এগিয়ে আসেনা। এক কথায় এলাকার অধিকাংশ লোকজনই আনিছুরের প্রতারনা ও শোষণ মূলক কর্মকান্ডের কারণে তার প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জোকাবিল সমিতির বাদ পড়া এক সদস্য জানান, তিনি আনিছুরকে জোকাবিল সমিতির শেয়ার ক্রয় বাবদ আট লক্ষ টাকা দিয়েছেন। বিগত দুই বছরেও তিনি ওই বিলের একটি টাকাও লাভ্যাংশ পাননি এমনকি মূলধন ফেরত পাননি। সর্বশেষ তাকে সমিতি থেকে অন্যায় ভাবে বাদও দেওয়া হয়েছে। তিনি ছাড়াও এমন শত শত সদস্যকে আনিছুর গায়ের জোরে সমিতি থেকে বাদ দিয়ে দেন। তাদের লভ্যাংশ দুরের কথা তাদের মূলধনও ফেরত দেওয়া হয়নি। এভাবে অন্যের টাকা আত্মসাত করে আনিছুর রাতারতি জিরো থেকে হিরো বনে গিয়ে এলাকায় স্বষোষিত মাফিয়া ডনে পরিনত হন। তার কথা মানলে সমিতিতে ঠাঁই নচেৎ বহিস্কার। স্বঘোষিত এই মাফিয়া ডন জামায়াত থেকে উঠে এসে জুড়ে বসে এলাকার দীর্ঘদিনের ত্যাগী আওয়ামী নেতা কর্মীদের গোদের উপর বিষফোঁড় হয়ে দাঁড়ান। স্বঘোষিত এই মাফিয়া ডন জোকা বিলের দখল বজায় রাখতে এলাকায় দেড়শ ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেন।

এসব ক্যাডার বাহিনীর সদস্যদের এলাকায় টহল দেওয়ার জন্য তিনি একটি করে মোটরসাইকেলও কিনে দেন।

সুত্র মতে গত ১৪ এপ্রিল ওই সব ক্যাডার বাহিনীরা মোটরসাইকেলে দেশীয় অস্ত্র সজ্জিত হয়ে বিল এলাকায় সাধারন কৃষকদের নির্মিত একটি ভাউড় ( অস্থায়ী চালা ঘর) ভেঙ্গে তাতে অগ্নি সংযোগ করে।

এই ঘটনার আগেরদিন জোকবিল মৎস সমিতির সাধারন সম্পাদক বাদী হয়ে দোলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে হাট মাদনাগর গ্রামের মৃত জনাব আলীর ছেলে উজ্জল হোসেন সহ ১৪ জনকে আসামী করে বাগামারা থানায় একটি চাঁদা বাজির এজাহার দায়ের করে। তবে পুলিশ এই ঘটনার কোন সত্যতা ও ভিত্তি না পেয়ে মামলা রেকর্ড করা থেকে বিরত থাকে। ওই দিন অগ্নি সংযোগের ঘটনার পর বিলের প্রকৃত জোতদার ও সাধারন কৃষকরা থানায় অভিযোগ দায়ের করার জন্য উদ্যোগ নিয়ে তাদেরকে হত্যা করে বিলের মধ্যে পুতে ফেলার হুমকি দেয় আনিছুরের ক্যাডার বাহিনী। তারা হুমকি দিয়ে বলে, থানায় আমাদের অভিযোগ দেয়নি তাই তাই তোদেরকেও থানার আশপাশে ভিড়তে দেওয়া হবে না।

জোকাবিলের এই লোমহর্ষক হত্যাকান্ড নিয়ে দীর্ঘ সময় কথা হয় বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) নাছিম আহম্মেদের সঙ্গে।

তিনি জানান, জোকা বিল সংলগ্ন প্রায় ৭/৮ টি গ্রামের শত শত মানুষের রুটি রুজি ও স্বার্থ এর সাথে জড়িত। ঘটনার কয়েকদনি আগে থেকে সেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে সহিংসতা ও উত্তেজনা দেখা দেয়। আমি সেখানে গিয়ে উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলি। উভয়ে এই সমস্যার একটি শান্তিপূর্ন সমাধান দাবী করেন। এই অবস্থায় সেখানে যে কোন পক্ষের মামলা গ্রহন করে কোন আসামী গ্রেফতার করলে পরিস্থিতি ব্যাপক সহিংস রুপ ধারন করতো এবং ১০/১২ জনের মৃত্যুর আশাংকা ছিল। তাই বিষয়টি ভাবে মিমাংসার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই দিন ছিল মিমাংসার দিন। এই প্রস্তুতি নিয়ে সবাই সেখানে যাওয়া শুরু করলে তখনই মুহূর্তের মধ্যে হত্যাকান্ডটি সংঘঠিত হয়। তবে এই হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। অনেক গুলো ক্লু ইতিমধ্যে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা খুনিকে শনাক্তের চেষ্টা করছি। পাশাপাশি এই হত্যা কান্ড নিয়ে অযতা কেউ যাতে হয়রনাীর শিকার না হয় সেদিকে আমরা সজাগ দৃষ্টি রেখেছি। এ বিষয়ে বাগমারার ইউএনও জাকিউল ইসলাম জানান, ওই দিন হত্যাকান্ড স্থল পরিদর্শনে এসেছিলেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মহোদয় এস,এম আব্দুল কাদের। স্যার আমাদের এই হত্যাকান্ডে নিহতের পরিবার যাতে ন্যায় বিচার পায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।

এ দিকে গত বুধবার এই হত্যাকান্ডের চারদিনে পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখনও এই হত্যাকান্ডের মূল হোতাদের গ্রেফতার করতে পারেনি। হত্যাকান্ডের পর ওই দিন রাতে নিহতরে ছেলে মহসিন বাদী হয়ে মোট ৩৭ জনকে আসামী করে বাগমারা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। তবে এই হত্যাকান্ডের পর ওই দিন ঘটনাস্থলের আশেপাশের এলাকা থেকে সন্দেহ ভাজন যে ১০ জনকে আটক করে পুলিশ পরে তাদের ১৫৪ জেল হাজতে প্রেরন করা হয়। এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা(ওসি) নাছিম আহম্মেদ বলেন, আমরা চাই প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার করে আইনে সোপর্দ করতে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ সন্দেহ ভাজন হিসাবে যে ১০ জনকে আটক করা হয়েছিল তাদেরকে ১৫৪ ধারায় আদালতে প্রেরন করা হয়।