রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪

রি সোল জু: পর্দার পেছনে থাকা উত্তর কোরিয়ার অঘোষিত রানী

SONALISOMOY.COM
নভেম্বর ৯, ২০১৯
news-image

ডেস্ক রিপোর্ট : আজকের বিশ্ব রাজনীতি আলোচনা করতে গেলে যে মানুষটির নাম না বললেই নয়, তিনি বর্তমান উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উন। আলোচনা রাজাদের নিয়েই হয়, ইতিহাস রানীদের কথা কতটুকু মনে রাখে? এক্ষেত্রেও একদম তা-ই। রাজনীতির মাঠ এখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বা রাশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি কিমের বক্তব্য, পদক্ষেপ আর আলোচনায় সরগরম, এর মাঝে আমেরিকার ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প বা কিমের স্ত্রী রি সোল জুকে নিয়ে তেমন আলোচনা নেই বললেই চলে। কিন্তু তা-ই বলে তাদের জীবন কিন্তু কম ঘটনাবহুল আর রহস্যঘেরা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের উঠে আসতে দেখা যায় একদম সাধারণ জীবন থেকে দেশের সর্বোচ্চ মর্যাদার ব্যক্তির স্ত্রী-রূপে। অন্যান্য দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিদের স্ত্রীদের সম্পর্কে বর্তমানের গণমাধ্যমের কল্যাণে তা-ও সাধারণ মানুষ কিছুটা জানতে পারে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার একচ্ছত্র নায়কের পরিবার যেন পুরো পৃথিবীর কাছেই এক জলজ্যান্ত রহস্যের নাম। কিম জং উনের দারুণ সুন্দরী স্ত্রীর সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের খুব বেশি তথ্য জানা নেই। অথচ আজকের ও সামনের দিনগুলোতে কিন্তু উত্তর কোরিয়া যে বিশ্ব রাজনীতির একটা মহারথী হয়ে আছে, তা তো তর্কের অপেক্ষা রাখে না।

রি সোল জুকে কিমের সাথে প্রথম দেখা যায় ২০১২ সালে। ৩৩ বছর বয়সী কিমের থেকে তার সুন্দরী স্ত্রী কয়েক বছরের ছোট বলে জানা যায়। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই রি কে উত্তর কোরিয়ার ফার্স্ট লেডি হিসাবে কিমের পাশে প্রথম ক্যামেরাবন্দি করে দেশটির গণমাধ্যম এবং ২৬ জুলাই বিশ্ব অন্যান্য দেশ উত্তর কোরিয়ার গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রথম তার সাথে পরিচিত হয়।

রি সোল জুয়ের পরিচয়, পেশা, ব্যক্তিজীবন ও পরিবার সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম তার ব্যাপারে টুকরো টুকরো তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি কিমের সাথে তার বিয়ের সময়ও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। তবে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে যে, সময়টা ২০০৯ বা ২০১০ এর মধ্যেই হবে। কিমের সাথে গাঁট বাঁধার আগে রি উত্তর কোরিয়ার জাতীয় ক্রীড়া দলের চিয়ারলিডার ছিলেন বলে জানা যায়। আর তাই দলের সাথে রি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন, যার মধ্যে আছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া।

বিয়ের আগে থেকেই কিম ও রি উভয়ই দেশটির ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের এবং সেনাবাহিনীর অভিজাত শ্রেণীর সাথে সম্পর্কিত ছিলো। ধারণা করা হয়, সেখান থেকেই তারা একে অপরের সাথে পরিচিত হন। রি’র বাবা দেশটির বিমানবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলে ধারণা করা হয়। আবার কিমের অন্যতম প্রধান সহায়তাকারী এবং বিমানবাহিনীর প্রধান রি ইয়ং কলেরও নিকটস্থ ব্যক্তিদের একজন হওয়ায় সেনাবাহিনী শাসিত উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির অর্ধাঙ্গিনী হয়ে উঠতে পারেন রি। আবার অনেক সূত্র এটাও দাবি করে যে, রি’র বাবা একজন শিক্ষক এবং মা একজন ডাক্তার। আনুমানিক ২৮ বছর বয়সী রি তিন সন্তানের জননী বলে জানা যায়। খুব কম সময়ই এই রহস্যময় নারীকে জনসম্মুখে পাওয়া যায়। তবে বেশিরভাগ সময়ে উত্তর কোরিয়ার কোনো সফল পারমাণবিক পরীক্ষার সময় কিমের পাশে হাস্যোজ্জ্বল রিকে দেখা যায়।

কিমের বিয়ের সময় ও অন্যান্য বিবরণ না পাওয়া উত্তর কোরিয়ায় কোনো আশ্চর্য ও নতুন ঘটনা নয়। বরং এখানে বলে রাখা ভালো, কিমের পিতা নিজের একাধিক স্ত্রীর কাউকেই কখনো জনসম্মুখে আনেননি। কিমের বিয়ের পরের বছর রি তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দেন। যদিও শিশুটি ছেলে না মেয়ে, তা জানা যায়নি। ব্যক্তিজীবনে রি কিম সুং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী। এছাড়া সঙ্গীতেও রয়েছে তার যথেষ্ট দখল। চীন থেকে কণ্ঠসঙ্গীতের তালিম নেন তিনি, অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন দেশের অনেক অনুষ্ঠানে। এখন অবশ্য উত্তর কোরিয়া তাদের ফার্স্ট লেডির গায়িকার পরিচয় মুছে ফেলতে বেশ সচেষ্ট। ২০১২ সাল থেকে হঠাৎ রি’র সবার চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার কারণ জানা যায়, যখন দেখা যায় পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের মা হয়েছেন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই দম্পতির তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়, যদিও এবারও জানা যায় না সে পুত্র নাকি কন্যা।

১৯৮৫-৮৯ সালের মধ্যে রি জন্মগ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হয়। তবে তার জন্মস্থান সম্পর্কে সঠিকভাবে কোনো স্থানের কথা বিশ্ববাসী এখনো জানতে পারেনি। উত্তর কোরিয়ার শাসকশ্রেণী মনে করেন, তথ্যই ক্ষমতা। আর তাই বাইরের পৃথিবী যত বেশি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে জানবে, ততই তাদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। আর রি তো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন, তাই তার জীবনের সবকিছুই রাখা হয় কঠোর গোপনীয়তায়। আর সেজন্য রি’র শৈশবও তার বর্তমান জীবনের মতোই সবার কাছে অজানা। এত কঠোরতার মধ্যে থেকে তাই যতটুকুই জানা যায়, তা-ই উপরি পাওনা হিসেবে ধরে নেওয়া যায়।

দেশটির দ্বিতীয় কুমসং মডেল স্কুলে রিয়ের প্রথম জীবনের পাঠ সম্পন্ন হয় এবং উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি যান দ্বিতীয় কিম সুং বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পরিবার সম্পর্কে সেভাবে জানা না গেলেও, তিনি কোনো রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পরিবার থেকে এসেছেন- এ ধারণাই বিশ্লেষকদের সমর্থন পায় বেশি। তবে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, ক্যারিয়ার গড়ার সময় বেশ কয়েকবার তিনি দেশটির খেলোয়াড়দের দলের সাথে দক্ষিণ কোরিয়া ভ্রমণ করেছেন। আবার অনেক অনুসন্ধানকারী এটাও দাবি করেন যে, রি গানকে যখন পেশা হিসেবে বেছে নেন, তখন এক সময়ে তিনি চীনের অনেক ক্লাব, রেস্টুরেন্ট ও সরাইখানাতে গান পরিবেশন করতেন। গায়িকা হিসাবে যদিও রিয়ের বেশ সুনাম আছে, তবুও তাঁর অতীতের সঙ্গীত জীবনের সব গানের রেকর্ডিং উত্তর কোরিয়া কর্তৃপক্ষ সফলভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে।

সবকিছুর পরও একটি কথা কিন্তু বলতেই হবে, রি উত্তর কোরিয়ার খুব কম সংখ্যক ভাগ্যবান মানুষদের একজন, যারা তাদের জীবন কিছুদিনের জন্য হলেও নিজেদের সাধমতো বেঁচে থাকতে পেরেছেন। আবার উত্তর কোরিয়ার মতো দরিদ্র একটি দেশের একনায়কের স্ত্রী হিসাবে রিয়ের দামি ব্র‍্যান্ডের পোশাক ও ‘ডাইয়োর’, ‘চ্যানেলের’ মতো অত্যন্ত দামি ব্র‍্যান্ডের শৌখিন ব্যাগের ব্যবহার তাকে বারবার আলোচনাতেও এনেছে।

২০১৩ সালের প্রথম দিকে রি এই দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান শিশুকন্যা জু রিয়ের জন্ম দেন। দেশটির পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা বাধ্য হয় স্বামীদের আনুগত্য মেনে নিতে। আবার অন্যদিকে সর্বোচ্চ শাসক হিসেবেও মেয়েদের থাকার নিয়ম দেশটি প্রচলিত নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায়, রি’র উপর কিমের পরিবারের একনায়কন্ত্রের উত্তরসূরী হিসাবে ছেলেসন্তান জন্ম দেওয়ার যথেষ্ট চাপ রয়েছে। বিশ্ব গণমাধ্যমে গুজব আছে, তৃতীয় সন্তানের জন্মের সময় তারা নাকি পুত্রসন্তানের আশা করেছিলো। আবার উত্তরাধিকারী দিতে না পারলে কিমের পুনরায় বিয়ে করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শেষপর্যন্ত কী হয়, তা নিয়ে উত্তর কোরিয়ার প্রশাসন কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখলেও পুরো পৃথিবীর আগ্রহ কিন্তু তাতে একটুও কমে না। আর গণমাধ্যম এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও যে এত সহজে তাদের ঘরের খবর না জেনে ছেড়ে দেবে না, তা-ও নিশ্চিন্তে বলা যায়।