বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

তিন টাকার বিদ্যুতে ঘণ্টায় ৬০০ লিটার অক্সিজেন

SONALISOMOY.COM
জুলাই ১, ২০২১
news-image

নিজস্ব প্রতিনিধি: চলছে করোনার দুঃসময়। সিলিন্ডারভর্তি অক্সিজেনই কারো করো জন্য হয়ে উঠছে বাঁচার শক্তি। তবে মুমূর্ষু রোগীর চাপে কখনো কখোনো দেখা দিচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঘাটতি। এ রকম প্রেক্ষাপটে বগুড়ার এক বিজ্ঞানীর হাত ধরে উঁকি দিচ্ছে আলোর ইশারা। সংকটময় এই মুহূর্তে পুরোপুরি দেশি প্রযুক্তিতে অক্সিজেন তৈরির যন্ত্র উদ্ভাবন করে তাক লাগিয়েছেন যন্ত্র প্রকৌশলী মাহমুদুন নবী বিপ্লব।

তাঁর এই যন্ত্র দিয়ে মাত্র তিন টাকার বিদ্যুৎ খরচে প্রতি ঘণ্টায় উৎপাদন করা যাবে ৬০০ লিটার বিশুদ্ধ অক্সিজেন। প্রতি লিটারে যার দাম দাঁড়ায় ০.০০৫ পয়সা। যন্ত্রটি ব্যবহার করে একসঙ্গে পাঁচজন করোনা রোগী পুরোপুরি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারবে। প্রয়োজনে এই যন্ত্রের সক্ষমতা আরো বাড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন এই যন্ত্রবিজ্ঞানী। যন্ত্রটি এরই মধ্যে সরকারের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) বিভাগে প্রদর্শনীর জন্য নেওয়া হয়েছে। এখন সেটি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির অপেক্ষায় রয়েছে।

বাতাসের ৫ ভাগের ১ ভাগই অক্সিজেন। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সেই অক্সিজেনই গ্রহণ করতে পারে না, পারলেও সেটি প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম হয়ে যায়। তখন রোগীকে দিতে হয় সিলিন্ডার অক্সিজেন। আর এই অক্সিজেন তৈরি হয় কারখানায়। বিপ্লবের এই অক্সিজেন তৈরির যন্ত্র করোনা রোগীদের শ্বাসজনিত সমস্যা দূর করবে। একই সঙ্গে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে একাধিক রোগীর জন্য ব্যবহার করে জীবন বাঁচাতে সহায়তা করবে। বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক এই শিক্ষার্থী এর আগে ইনটেলিজেন্ট ডিসি ভেন্টিলেশন সিস্টেম, বন্যা সতর্কীকরণ যন্ত্র এবং বেবি ইউরিন অ্যালার্ম বেড উদ্ভাবন করে সাড়া ফেলেছিলেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক লুত্ফুল কবীর বলেন, বহনযোগ্য অক্সিজেন তৈরির যন্ত্র যদি দেশে বানানো যায় তাহলে শুধু সাশ্রয়ী দামে নয়, একই সঙ্গে বিভিন্ন চাহিদার যন্ত্রও দেশেই বানানো সম্ভব হবে।

যন্ত্র প্রকৌশলী মাহমুদুন নবী বিপ্লব জানান, যন্ত্রটি সম্পূর্ণভাবে দেশীয় উপাদান দিয়ে তৈরি। খরচ কম, সহজলভ্য এবং পোর্টেবল। প্রয়োজনে বাসাবাড়ি, অফিস, হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ যেকোনো স্থানে এই যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, বাতাস থেকে যন্ত্রটি ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ বিশুদ্ধ অক্সিজেন উৎপাদনে সক্ষম। তাঁর এই যন্ত্র তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে মৃদু শব্দের কম্প্রেসর, কপার টিউব, ডাস্ট ফ্রি এয়ার ফিল্টার, হাইপ্রেসার কন্ট্রোলিং ডিভাইস এবং ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি দিয়ে দূর থেকে যন্ত্রটি চালানোর জন্য আইওটি বেইস মনিটর। ২৮ থেকে ৩০ কেজি ওজনের যন্ত্রটি ট্রলির মাধ্যমে সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়।

বিপ্লব আরো জানান, তাঁর এই যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে কেআর অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর। তিনি এটি আন্তর্জাতিক মান সংস্থা আইএসও ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব ব্যবহারবিধি ও নির্দেশিকা অনুসরণ করে তৈরি করেছেন। প্রয়োজনে যন্ত্রটি সর্বোচ্চ ১০০ জনের সেবা দেওয়ার মতো করে তৈরি সম্ভব। এটি ৫৫০ ওয়াট বিদ্যুত্শক্তি ব্যবহার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত অক্সিজেন প্রবাহ (৯২ শতাংশের ওপরে বিশুদ্ধতা) নিশ্চিত করে।

জানা যায়, যন্ত্রটি বাতাস গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর ভেতর অবস্থিত বিশেষ রাসায়নিক বাতাসের নাইট্রোজেনকে একটি সলেনয়েড ভাল্বের মাধ্যমে আলাদাভাবে বের করে দেয়। একই সঙ্গে অক্সিজেনকে আলাদা করে সংরক্ষণ করে। এর ফলে যন্ত্রের ভেতরে অক্সিজেনের ঘনত্ব বেড়ে ৯০-৯৫ শতাংশে পৌঁছে, যা মানবদেহে দেওয়া যায়।

বিপ্লব জানান, যন্ত্রটিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়েছে। এ ছাড়া এতে সংযোজিত হয়েছে নিয়ন্ত্রণ (কন্ট্রোল) ও তদারকির (মনিটরিং) ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে অক্সিজেন ঘনত্ব থেকে শুরু করে তাপমাত্রা, ফ্লো রেট—সবই সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। যেহেতু এটি হাসপাতালে ব্যবহার করা হবে, সে জন্য শব্দশোষক কম্প্রেসর ব্যবহার করে চালু অবস্থায় শব্দের মাত্রা গ্রহণযোগ্য রাখা হয়েছে। এ ছাড়া তাত্ক্ষণিক বিদ্যুৎ (আইপিএস) সংযোগের সুযোগও রাখা হয়েছে, যাতে দেশের যেকোনো গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকলেও এটি ব্যবহার করা যায়। আর বিদ্যুতের ব্যাকআপ না পেলেও ভেতরে একটি রিজার্ভ ট্যাংকের রক্ষিত অক্সিজেন দিয়ে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরও সাত মিনিট ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে রোগীকে সেবা দিতে পারবে।

বিপ্লবের মতে, দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তা পাওয়া গেলে করনোকালে যন্ত্রটি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ার পরও শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য এটির ব্যবহার অব্যাহত রাখা যাবে। সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।

ইতিমধ্যে যন্ত্রটির বর্ণনা এবং কার্যকারিতা সরকারের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) বিভাগের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। সেখানে বিপ্লবের এই উদ্ভাবনটি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে তালিকার ১ নম্বরে রয়েছে বলে জানা গেছে। এটুআইয়ের কর্মকর্তা (ইনোভেশন এক্সপার্ট ডিভাইস) তৌফিকুর রহমান বলেন, গত ১৭ জুন ঢাকায় সারা দেশের মোট ছয়টি উদ্ভাবন প্রদর্শিত হয়। এর মধ্যে বিপ্লবেরটি পয়েন্টের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি কোনো করোনা রোগীকে এই যন্ত্রের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয় তাহলে তাকে ভেন্টিলেটরে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে কমে আসবে।

বিপ্লবের দাবি, তার এই মেশিনটি একেবারে আধুনিক। একটি মোবাইল সফটওয়্যারের মাধ্যমে দূর থেকে এটির সব অপারেটিং সিস্টেম তদারক করা সম্ভব। এই কাজে তাঁকে সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে সহযোগিতা করেছেন প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ মহিবুর রহমান।

বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেট্রনিকস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আমিনুর ইসলাম বলেন, ‘করোনার এই দুর্যোগে আধুনিক এ যন্ত্রটি সব শ্রেণির মানুষ ব্যবহার করতে পারবে। কারণ এটির ব্যবহার খরচ একেবারেই কম।’