বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

রওনক আশরাফী প্রেমার উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্প

SONALISOMOY.COM
জুলাই ২৭, ২০২১
news-image

চাকরি নয়, অন্য কিছু করতে হবে; এমন চিন্তা থেকেই উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন। স্বপ্নের শুরু ২০১২ সালে। তবে এর মধ্যে কেটে গেছে বেশ কিছু সময়। বিয়ের পর থেকে তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল সংসারের পাশাপাশি কিছু একটা করবেন। পড়াশোনার চাপ তো ছিলই, করতে হয়েছে এমবিএ। এরপর বছর খানিক আবারো শুধু চিন্তা করেই কেটে গেছে। কি করা যায়, কি কবর এসব ভেবে। ২০১৬ সালে আর বসে না থেকে এফ-কমার্স নিয়ে কাজ শুরু করেন। তখন ফেসবুকে বসে বসে দেখতেন মানুষের বিভিন্ন ধরনের কাজ। চিন্তা করতেন কোন ধরনের প্রোডাক্ট নিয়ে মানুষ কাজ কম করে, কোন জিনিসগুলো মার্কেটে কম পাওয়া যায়। এরমধ্যে তার হ্যাসবেন্ডের সঙ্গে থাইল্যান্ড যান ব্যক্তিগত কাজে; সেখানে গিয়েও মাথায় একটাই চিন্তা, কিছু একটা করতে হবে। থাইল্যান্ডের বাজার ঘুরে ঘুরে দেখে সিদ্ধান্ত নিলেন কাষ্টমাইজড আইটেম নিয়ে কাজ শুরু করবেন। এটাই ফাইনাল, এই উদ্যোগ নিয়েই এগিয়ে যাবেন। তখন বাংলাদেশেও এসব আইটেমের প্রচলন কম ছিল। এভাবেই শুরু পথচলা। চলার পথে এখন যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের উদ্যোগ এবং কাজ।

উদ্যোক্তা রওনক আশরাফী প্রেমা। যার ব্যবসা শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। শপিং গ্লোরিষ্ট নামে এফ-কর্মাস দিয়ে। দেড় লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু। তখন ৫৫০ টাকা গড়ে প্রায় ৪৫টি অর্ডার পেয়েছিলেন। এই ৪৫ অর্ডারই এগিয়ে যাবার প্রেরণা ছিল প্রেমার। ২০২১ সালে এসে সে তালিকা বেশ লম্বা হয়েছে। ১৭ হাজার কাস্টমার যুক্ত হয়েছেন শপিং গ্লোরিষ্টের সঙ্গে। প্রতিমাসের হাজার খানিক কাস্টমারকে পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছেন প্রেমা। তবে এখন শুধু কাষ্টমাইজড আইটেমই নয়, যুক্ত হয়েছে থাই অরজিনাল কসমেটিকসহ আরো অনেক কিছু।

রওনক আশরাফী প্রেমা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি করেন। ইনডিপেডেন্ট ইউনির্ভাসিটি থেকে বিবিএ, সাউথইস্ট ইউনির্ভাসিটি থেকে এমবিএ করেছেন। উদ্যোক্তা হয়ে উঠার আগে চাকরি করতেও চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সেসবে মন টানেনি। পড়াশোনা শেষ করে তাই ব্যবসাতেই মনোযোগী হয়ে উঠেন। তবে স্কুল জীবন থেকেই প্রেমার মাথায় ক্রিয়েটিভ কাজ করার প্ল্যান ঘুরপাক খেতো। ইচ্ছা ছিল ব্যারিষ্টারি পড়বেন। কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। এমবিএ করেছেন, মেজর ছিল এইচআর।

প্রেমা কোনোদিনও চিন্তা করেননি ব্যবসা করবেন। কারণ বিয়ের আগে করতেন চাকরি। বিয়ের পর তার মনে হলো চাকরি করলে ঘরে বেশি সময় দিতে পারবেন না। এমন সময় তার হাসবেন্ড জানালেন, চাইলে তিনি ব্যবসা করতে পারেন। সেটা ফেসবুক অথবা অনলাইনে। এ কথা শোনার পর প্রেমা অবাক হয়েছিল। কারণ তখন এ ধরনের ব্যবসা বা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কাউকে চিনতেন না। কিভাবে সামনে এগিয়ে যাবেন, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, সে সম্পর্কেও কিছু জানতেন না। পাশাপাশি কি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করবেন সে সম্পর্কেও ছিল না কোনো ধারনা। এরপর থাইল্যান্ড যাবার পর তো কাস্টমাইজ আইটেমের প্ল্যান মাথায় আসে। শুরু হয় ব্যবসা। অনেক বাঁধার সম্মুখীন হোন প্রেমা। শুরুতে একা একা সব কিছু খুঁজে বের করতে হয়েছে। কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ এমনকি ভেন্ডর থেকে শুরু করে সব কিছু। প্রেমার হাসবেন্ডই একমাত্র পাশে ছিল বুদ্ধি কিংবা সাহস দেবার জন্য। যতটুকু এগিয়ে যাবার শক্তি পেয়েছে ততটুকু তার হ্যাসবেন্ডই দিয়েছে। নানা বাঁধা থাকা সত্ত্বেও প্রেমা থেমে যাননি। থেমে যাননি লাভ-লোকসান দেখে। থেমে যাননি মেয়ে বলে। অনেক কথা শুনতে হয়েছে, তবুও সেগুলো ঝেরে ফেলে আপনশক্তিতে এগিয়ে গেছেন এবং এখনও এগিয়ে চলেছেন।

রওনক আশরাফী প্রেমা নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলেন, বর্তমানে আমি অনলাইন পেইজের মাধ্যমে হোলসেলের বিজনেস করছি। যেখানে আমার ফিক্সড কিছু পেইজসহ অনেক শপমালিক আছেন। পাশাপাশি অনেক কর্পোরেট ক্লাইন্টও আছেন, যাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রোডাক্ট দিচ্ছি। ২০২০ সাল থেকে করোনার জন্য অনলাইনের রিটেল সাইট অফ করে রেখেছি। কারণ কার্গো ফ্লাইট থেকে শুরু সব কিছুতে সমস্যা করোনার কারণে। যার জন্য রিটেল কাজ করছি না। ব্যবসার শুরু থেকে কাস্টমারদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক ভালো, আমার কথার কোনো নড়চড় হয়নি এখনো। যে সময় প্রোডাক্ট দিতে চেয়েছি, সে সময়ই দিয়েছি। কথা বরখেলাপ হয়নি কখনো। এ কারণেই রিটেল সাইট অফ রেখেছি। করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে, কার্গো ফ্লাইট আগের মতো চালু হলে তখন আবার অনলাইনে রিটেল কাজ শুরু করব। আমার ব্যবসার শুরুতে ২টি আইটেম নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে আমাকে ভ্যারাইটিজ আইটেম নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। স্পেশালি আমি হোলসেল বেশি ফোকাস করা শুরু করেছি। যাই হোক, ব্যবসার পাশাপাশি আরো বেশ কিছু উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে পরেছি বর্তমানে। ই-কর্মাস সাইটের লাইভ কর্মাস নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম পরামর্শক হিসেবে কাজ করছি। পাশাপাশি বাংলাদেশে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে হেড অব এইচআর হিসেবেও কাজ করছি। এছাড়া একটি কানাডিয়ান ক্লাউড কিচেন কোম্পানির সঙ্গে কাজ শুরু কবর। সেখানে ইতালিয়ান এবং ইন্ডিয়ান ফুড আইটেম এতে প্রাধাণ্য পাবে। বাংলাদেশে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু হবে প্রতিষ্ঠানটির।

উদ্যোক্তা প্রেমার কাজে সফলতার পাশাপাশি দুঃখ বা সুখের স্মৃতিও কম নয়। অনেক কথা শুনতে হয়েছে। তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতো শুরুর সময় অনেকে। নিজেকে অসহায় মনে হতো। হ্যাসবেন্ডই ছিল একমাত্র ভরসার জায়গা। রাশেদুন নবী। কর্পোরেট মানুষ। সারাদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। যতটুকু সময় পেতেন প্রেমাকে দিতেন। বিয়ে, সংসার, বাচ্চা এসব নিয়ে সবাই তাকে ভাবতে বলতেন, কেউই উৎসাহ দিতেন না। তারপরও থেকে থাকেননি। কাজের মাধ্যমে সফলতা আসবে ভেবেই সবার সব কথা সহ্য করেই কাজ করে গেছেন এবং যাচ্ছেন। বর্তমানে তার ভালো লাগে যখন সবাই বলে ভালো করছেন। তার বাবা যখন প্রথমবার বলেছিলেন, আমার মেয়ে অনেক ভালো কাজ করছে তখন এগিয়ে যাবার শক্তি দ্বিগুন হয়েছিল প্রেমার। পাশাপাশি এমন কিছু মানুষ আছে যারা বলেন, ভালো করছে। সে কথাগুলো প্রেমাকে সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যোগায়। তবে প্রেমা সব সময় স্বীকার করে তার হ্যাসবেন্ডই তাকে সাহস, শক্তি এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তার কারণে প্রেমার এতোদূর আসা। আজকের উদ্যোক্তা রওনক আশরাফী প্রেমা হয়ে উঠা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে রওনক আশরাফী প্রেমা বলেন, ইচ্ছা আছে করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে আউটলেট দেবো বাংলাদেশে। পাশাপাশি নিজের উদ্যোগে নারীদের নিয়ে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান করব। যেখানে যেসব নারীরা ব্যবসা করতে চায়, যাদের কোনো সাপোর্ট নেই, কাউকে চিনে না, ভয় পাচ্ছে, কিভাবে কি করবে তাদের প্রাধাণ্য দেয়া হবে। এছাড়া কিভাবে কাষ্টমার হ্যান্ডেল করতে হয় এমন বিষয়গুলো নিয়ে ট্রেনিং দেয়া, যেন তারা ভালো মতো প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরাই কিছু একটা করতে পারে। এমন ছোট বড় বেশ কিছু ইচ্ছা আছে আমার। কারণ আমি নিজে মেধা, শ্রম, সাহস এবং কাজ করেই এই জায়গা তৈরি করেছি। কারণ আমি চাই অন্যরা যাতে কষ্ট না পায়। যাতে সহজেই বিষয়গুলো জানতে এবং শিখতে পারে। আমার জন্য যেন আরো অনেক মেয়েদের আয়ের পথ তৈরি হয়। আমি যেন নারীদের আরো উৎসাহ দিতে পারি। নারী বলে যেন কেউ পিছিয়ে না থাকে। নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চাই যেন আমাকে দেখে আরো ১০ জন মেয়ে বলে, ঘরে বসে না থেকে কিছু একটা করা উচিত।