শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সাঁওতাল উচ্ছেদ: নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন ডিসি, এবার তলব এসবি সুপারকে

SONALISOMOY.COM
ডিসেম্বর ১২, ২০১৬
news-image

নিজস্ব প্রতিবেদক:  গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় গুলির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের আদেশে সাঁওতালদের ‘বাঙ্গালী দুষ্কৃতিকারী’ বলার জন‌্য হাই কোর্টের তলবে হাজির হয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক।

ওই একই শব্দের জন‌্য এবার গাইবান্ধার পুলিশের বিশেষ শাখার সুপারকে তলব করেছে আদালত। তাকে আগামী ২ জুনয়ারি হাই কোর্টে হাজির ওই ব‌্যাখ‌্যা দিতে হবে।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাই কোর্ট বেঞ্চ সোমবার এই আদেশ দেয়।

ওই উচ্ছেদের ঘটনায় করা দুটি রিট আবেদনের শুনানিতে গত ৬ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের দেওয়া একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনার পর হাই কোর্ট এই বেঞ্চ তাকে তলব করে।

সেদিন আদালতের আদেশে বলা হয়, ‘বাঙ্গালী দুষ্কৃতিকারী’ একটি উন্নাসিক শব্দ। এ ধরনের শব্দ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা ব‌্যবহার করত। জেলা প্রশাসক ‘আইন অমান‌্যকারী’ বা অন‌্য কোনো শব্দ ব‌্যবহার করতে পারতেন। তা না করে কেন তিনি ‘বাঙ্গালী দুস্কৃতিকারী’ লিখেছেন, তার ব‌্যাখ‌্যা জানা প্রয়োজন।

সাঁওতালদের পক্ষে করা প্রথম মামলার বাদী স্বপন মরমুকেও ১২ ডিসেম্বর আদালতে হাজির করতে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার ও গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

সে অনুযায়ী গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ সোমবার সকালে হাই কোর্টে উপস্থিত হন। স্বপন মরমুকেও আদালতে নিয়ে আসে স্থানীয় প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক আদালতকে বলেন, গাইবান্ধা পুলিশের বিশেষ শাখার সুপার যে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাতে ‘বাঙ্গালী দুষ্কৃতিকারী’ শব্দটি ছিল, যা তদন্ত কমিটি গঠনের চিঠিতেও ‘অসাবধানতাবশত’ চলে আসে।

এ কারণে আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন জেলা প্রশাসক।

কিন্তু তার বক্তব‌্য অনুযায়ী, বিশেষ শাখার প্রতিবেদনেও ওই শব্দ থাকায় সংশ্লিষ্ট সুপারকে এরপর তলব করে আদালত।

রিটকারীপক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আদালত বিষয়টি ১৪ ডিসেম্বর পরবর্তী আদেশের জন‌্য রেখেছে।

সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। সেই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা।

এরপর সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন‌্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করেন। গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ওই জমি সাঁওতালদের ছিল না। ‘ভূমিদস্যুরা’ সাঁওতালদেরকে ‘ব্যবহার করেছে’। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাঁওতালদের দিয়ে ‘দখল করিয়ে পরে নিজেদের দখলে নেওয়া’। অন‌্যদিকে সাঁওতাল পল্লীর বাসিন্দারা বলছেন, তারা ‘বাপ-দাদার জমিতে’ থাকার অধিকার চান।

গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতালদের জানমাল রক্ষা, নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ, স্বাধীনভাবে চলা-ফেরার সুযোগ দিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), ব্রতী সমাজ কল্যাণ সংস্থা গত ১৬ নভেম্বর হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করে।

পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করে সাঁওতালদের ধান কাটার সুযোগ দিতে অথবা ধান কেটে তাদের বুঝিয়ে দিতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয় আদালত। সাঁওতালদের সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষায় ‘প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না’- তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়।

পাশাপাশি উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতালদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বাইরে চলাচলের ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেয় আদালত। তাদের নিরাপত্তার জন‌্য কী কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং উচ্ছেদের সময় ভাংচুর-লুটপাটের ঘটনায় কয়টি মামলা হয়েছে সে বিষয়ে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার ও গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসিকে ৩০ নভেম্বরের মধ‌্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে, যেখানে তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের ওই আদেশের অনুলিপিও ছিল।

এদিকে উচ্ছেদের সময় গুলিতে আহত সাঁওতাল দ্বিজেন টুডোর স্ত্রী অলিভিয়া হ্যামভ্রম এবং গণেশ মুরমোর স্ত্রী রুমিলা কিসকুর পক্ষে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ২১ নভেম্বর হাই কোর্টে আরেকটি রিট আবেদন করেন। সেখানে সাঁওতালদের ওপর ‘হামলার ঘটনা’ তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।

পরদিন এ বিষয়ে শুনানি করে রুল দেয় আদালত। সাঁওতালদের উচ্ছেদের নামে তাদের মারধর, লুটপাট, গুলি ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং উচ্ছেদের নামে ওইসব কর্মকাণ্ড কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

আসকের রিট আবেদনের বিষয়ে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এম আমিনউদ্দিন। অন‌্য রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করছেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।