শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বাগমারায় শিশু মারুফকে কেন হত্যা করলো সৎ মা

SONALISOMOY.COM
মে ৩, ২০২১
news-image

বাগমারা প্রতিনিধি: ফুটফুটে চেহারা আর হাস্যজ্জ্বল মুখ। সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা করে কাটে সারাটা দিন। স্কুলেও যাওয়ার বয়স হয়নি মারুফ হাসানের। পৃথিবীর ভালো মন্দ কোন কিছুই তার তেমন জানা নেই। রাত হলে ঘুমানো আর দিন হলে খেলা এটাই তার নিত্য দিনের কাজ। কারো সাথে শত্রুতা করারও বয়স হয়নি তার। বয়সও কেবল সাত। মা থাকলেও নেই তার আদর যতœ। মা অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করছেন। কি ছিল শিশু মারুফের ভবিষ্যতে। ৭ বছর বয়সের শেষ করে দেয়া হলো তার জীবন প্রদীপ। সৎ মায়ের সাথে মাত্র ৫-৬ মাসের সংসার জীবন মারুফের।

মারুফ হাসান তার বাবা শাহজাহান আলী এবং সৎ মা মুক্তা বেগমের সাথে থাকতেন। সেই সময়ের মধ্যে সৎ মায়ের অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাকে। অবশেষে নিজের অপকর্ম ঢাকতে শেষ মেষ বালিশ চাপা দিয়ে মারুফ হাসানকে হত্যা করলো তার সৎ মা। কথাটা শুনলেই শরীর শিউরে উঠে।

গত ৩০ এপ্রিল শুক্রবার ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার শুভডাঙ্গা ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামে। কয়েক মাস আগে মারুফের বাবার সাথে ১০ বছর বিবাহ জীবনের বিচ্ছেদ ঘটে তার মায়ের। তবে এই ঘটনার পিছানে রয়েছে না জানা অনেক কথা। সংসার তেমন ভাল না হলেও শাহজাহান আলীকে এক এক করে তিনবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়েছে। প্রথম বিবাহ গ্রামেই করেন। প্রথম স্ত্রীর একটি মেয়ে সন্তান আছে। মেয়ে সন্তানকে রেখে তিনি অল্প বয়সের মারা যান। সেই মেয়েটি বর্তমানে তার নানার বাড়িতেই থাকে।

এরপর দুর্গাপুর উপজেলার যুগিশো গ্রামের জনৈক ব্যক্তির মেয়ে মারুফা বেগমের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হয় শাহজাহান আলী। সেই পক্ষের একটি ছেলে হয় যার নাম মারুফ হাসান। তাতেই শেষ হলো না শাহজাহানের। তৃতীয় বিয়ের ভূত মাথায় চাপে তার। অবশেষে বছর খানের আগে রাজশাহীতে গিয়ে মুক্তা বেগমকে বিয়ে করে শাহজাহান আলী। মুক্তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার চরটেঙ্গাবর। তার পিতার নাম মাহাতাব মিঞা। মুক্ত বিয়ের আগে নাটোরে প্রাণ কোম্পানীতে চাকরী করতেন। শাহজাহাননের রাজশাহীতে দেখার হওয়ার পর বিয়ে হয়। মুক্তা অর্থের বিনিময়ে লোকজনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ঘটান বলে জানান স্থানীয়রা। বর্তমানে এটাই তার অর্থ উপার্জনের হাতিয়ারে পরিনত হয়ে উঠে।

গ্রামের বাড়িতে মারুফ আর তার মাকে রেখে রাজশাহীর ডিংগা ডোবা ভ্যান কলোনী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তৃতীয় স্ত্রী মুক্তা বেগমকে নিয়ে। বিয়ের পর থেকে টানা পোড়েন চলে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে। মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয় মারুফার সাথে। এরই মধ্যে তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে উঠেন শাহজাহান আলী।

গ্রামের বাড়িতে রয়েছে তার দুই কক্ষের একটি আধাপাকা বাড়ি। দুই স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে সেখানেই থাকবেন বলে মন স্থির করেন শাহজাহান। প্রায় ৫-৬ মাস আগে এই চিন্তা মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলেন তিনি। অবশেষে দু এক দিন একত্রে সংসার করলেও তা আর বেশি দিন এগোইনি।

তৃতীয় স্ত্রী মুক্তাকে সংসারে রেখে দ্বিতীয় স্ত্রী শিশু মারুফের মা মারুফাকে তালাক দেয় শাহজাহান আলী। সেই থেকে বাবার সাথে থাকতেন মারুফ হাসান। গ্রামের বাড়িতেও শুরু হয় মুক্তার দেহ ব্যবসা। শাহজাহান আলী কামলা দিয়ে সংসার পরিচালনা করেন। শাহজাহান আলী যখন বাড়িতে থাকে না তখন মুক্তা অন্যদের সাথে দেহ ব্যবসা করতে থাকেন। সেগুলো অনেক সময় শিশু মারুফ হাসান দেখে ফেলেন। সৎ মায়ের অনেক কিছু জানে মারুফ। ওই সব দেখায় যেন বাদসাজে মারুফের জীবনে।

দুনিয়া থেকে নিজের খারাপ কাজের স্বাক্ষি দুর করতে পরিকল্পনা সাজান মুক্তা বেগম। কয়েক দিন পর পর মারুফের হাত পা বেঁধে রোদের ভিতরে বাড়ির মধ্যে ফেলে রাখে। কথা বা চিৎকার দিলে দেখানো হয় হত্যার হুমকী সহ ভয়ভীতি। গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন স্থানে তাদের বাড়ি হওয়ায় কেউ দেখতেই পায়না মুক্তার এমন কর্মকান্ডের কথা।

বর্তমানে মারুফের মা তালাক নেয়ার পর অন্যস্থানে বিয়ে করে সংসার করছেন। অবশেষে সৎ মা মুক্তা বেগমের দেহ ব্যবসার বলি হতে জীবন দিতে হলো শিশু মারুফকে। মারুফা বেগম হঠাৎ খবর পায় তার ছেলে মারুফের মৃত্যুর খবর। স্বামীর বাড়ি থেকে ছুটে আসেন সন্তানের কাছে। সারা জীবনের মতো হারাতে হবে সন্তানকে সেটা ভাবতেও পারেননি মারুফা বেগম। ছেলের কাছে এসে শোকে কাতর হয়ে পড়েন তিনি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ছেলের মৃত দেহের পাশে।

অবশেষে জানাযা দেয়ার আগে নিজের ছেলের গোসল করান মা মুরুফা বেগম। গোসল করানো সময় দেখতে পান মারুফের মুখ সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কালো দাগ। তখন তিনি মারুফের মৃত্যুটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু না বলে অভিযোগ তুলেন। মারুফ মারা যায়নি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন শিশুটির মা। পরে দ্রুত ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশ।

শিশু মারুফের লাশের সুরতাল রিপোর্ট সংগ্রহ করেন পুলিশ। সেই সাথে বাড়িতে গিয়ে সৎ মা মুক্তা বেগম সহ শাহজাহান আলীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেন তারা। অপর দিকে শিশু মারুফ হাসানকে হত্যার অভিযোগে তার বাবা ও সৎ মাকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন শিশুর মা মারুফা বেগম।

এর আগে এই ঘটনার সর্ম্পকে জানার জন্য পুলিশ শিশুর বাবা, সৎ মা ও দুই চাচাকে থানায় নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুই চাচাকে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাবা শাহাজাহান আলী (৪৫) ও সৎ মা মুক্তা বেগমকে (২৫) গ্রেপ্তার দেখিয়ে শনিবার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।

কাফনের কাপড়ে মোড়ানো শিশু মারুফ হাসানের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেলে প্রেরণ করে পুলিশ। এদিকে শিশু মারুফ হাসানকে জীনে মেরে ফেলেছে বলে প্রচার করা হয়। দ্রুত লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেন বাবা ও সৎ মা। লোকজনও জানাজায় আসেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক সৈবুর রহমান বলেন, পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৎ মা মুক্তা বেগম হত্যাকা-ের সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। স্বামীর সহযোগিতায় শুক্রবার ভোর রাতে বালিশ চাপা দিয়ে শিশু মারুফ হাসানকে মেরে ফেলা হয়েছে। শিশু মারুফ হাসান দুষ্টুমি করে এটা মানতে পারছিলেন না। এসব ক্ষোভ থেকে শিশুকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।

বাগমারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আফজাল হোসেন বলেন, এসপি মহোদয়ের নির্দেশে ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের (সদর সার্কেল) সহযোগিতায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে দুই হত্যা মামলার মোটিভ উদ্ধার ও মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।