শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে সুখের সংসার শেষ

SONALISOMOY.COM
ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
news-image

নিজস্ব প্রতিবেদক: ১৯৯৪ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর ছোট দুই ভাইয়ের কাছে বোন আবেদাতুন ফাতেমা (আশা) ছিলেন অভিভাবকের মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের লেখাপড়া শেষে আবেদাতুন ফাতেমা যখন ঢাকা কলেজ থেকে পাস করা তানভীর কাদেরীকে বিয়ে করতে চান, মা ও ছোট ভাইয়েরা কেউ আপত্তি করেননি। তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন না, এমনই বিশ্বাস ছিল তাঁদের। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে জঙ্গি দলে যোগ দিয়ে সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছেন। ছারখার হয়ে গেছে পুরো সংসার।

এ নিয়ে গতকাল সোমবার কথা হয় আবেদাতুন ফাতেমার এক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় আফিফের (আবেদাতুনের ছেলে) লাশ আছে, পত্রিকায় এ ছবি দেখে আমাদের ভেতরে কী হচ্ছিল, সেটা বলে বোঝাতে পারব না। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে বাবা-ছেলের মৃত্যু, আরেক ছেলেসহ মা কারাগারে, এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।’

ওই আত্মীয় বলেন, ‘সুখের সংসার ছিল ওদের। স্বামী-স্ত্রী দুজনে উচ্চ বেতনে ভালো চাকরি করতেন। ফুটফুটে দুটি বাচ্চা। বুঝেশুনে বাচ্চাদের নিয়ে বিপথে গেল। এ জন্য শুধু ঘৃণাই করা যায় ওকে।’

আবেদাতুনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর স্বামী তানভীর কাদেরীর বাড়ি গাইবান্ধায়। স্বজন ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবেদাতুল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাবর রচনা প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্কে ভালো করতেন। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার সময় যেকোনো প্রতিবেদনের চমৎকার সূচনা লিখতেন। প্রথমে বাংলাদেশ টেলিভিশনে চাকরি নিয়েছিলেন। এরপর ব্রতী, ডিএফআইডি, মুসলিম এইড ঘুরে সেভ দ্য চিলড্রেনে চাকরি করেন। যমজ দুই ছেলে, চাকরি, সংসার সব মিলে ব্যস্ত জীবন। কখনো গাইবান্ধা থেকে শাশুড়ি, কখনো মা এসে ছেলেদের দেখাশোনা করতেন। কখনো আবার ছেলেরা দাদাবাড়ি বা নানাবাড়িতে গিয়ে থাকত।

তানভীর কাদেরী প্রথমে কল্লোল গ্রুপে চাকরি করেন। সেখান থেকে মুঠোফোন কোম্পানি একটেল ও রবি, তারপর ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং বিভাগে চাকরি করেন।

২০১৪ সালে আবেদাতুনের মা মারা যান। এরপর মাঝে মাঝে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেড়াতে যেতেন তিনি। নিকটাত্মীয়দের মতে, ২০১৪ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকেন স্বামী-স্ত্রী দুজনে। তানভীর কাদেরীর বদলে যাওয়াটা ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি হঠাৎ ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দেন। যুক্তি ছিল তিনি সুদ লেনদেন হয়, এমন প্রতিষ্ঠানে আর চাকরি করবেন না। আল সাকিনা হোম ডেলিভারি সার্ভিস নামে ব্যবসা শুরু করেন। আবেদাতুন তখনো সেভ দ্য চিলড্রেনে।

একজন নিকটাত্মীয় জানান, সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাবার বাড়ি যান আবেদাতুন ফাতেমা। তখন তানভীর কাদেরী তাঁর ছেলেদের সেখানকার কারও সঙ্গে মিশতে দেননি। বাচ্চাদের কথা বলায় নানা রকম বিধিনিষেধ দিতে থাকেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে যাওয়ার সময় আবেদাতুন বলেছিলেন, তাঁরা গাইবান্ধায় যাচ্ছেন। এরপর আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। বাড়ির লোকজন জানতেন, তাঁরা বিদেশে চলে গেছেন।

এই পরিবারের কেউ কারাগারে আটক আবেদাতুন ও তাঁর কিশোর ছেলের খোঁজ নেননি। তাঁরা শনিবার আশকোনায় নিহত আফিফ কাদেরীর লাশও নিতে চান না। কেন নিতে চান না? ওই আত্মীয় বলেন, তাঁরা এমনিতেই সমাজে একঘরে হয়ে যাওয়া এবং হেনস্তা হওয়ার ভয়ে আছেন।

একইভাবে তানভীর কাদেরীর পরিবারও আফিফের লাশ নিতে চায় না। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে আজিমপুরে নিহত তানভীরের লাশও নেয়নি তারা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা বাবার পাশে এখন রাখা হয়েছে ছেলের লাশও।

গতকাল সোমবার গাইবান্ধার পশ্চিম বাটকামারি গ্রামের বাড়িতে কথা হয় তানভীরের বাবা আবদুল বাতেন কাদেরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওদের কারণে আত্মীয়স্বজন আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। আমার দুই মেয়ে রয়েছে। তারাও আমার বাড়িতে আসছে না। এলাকার মানুষের কাছেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি।’

রূপনগরে পুলিশি অভিযানে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলামের পরিবারেরও একই হাল। জাহিদের হাত ধরে জঙ্গিবাদে জড়ান স্ত্রী জেবুন্নাহারও। তাঁদের দুই মেয়ে, একটা সাত বছরের, আরেকটা এক বছরের।

দুজনের পারিবারিক সূত্র জানায়, জাহিদ সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়ছেন শুনে দুই পরিবারই অসন্তুষ্ট ছিল। জাহিদ নিজের ও শ্বশুরবাড়িতে জানিয়েছিলেন, তিনি সেনাবাহিনীর চাকরিতে থেকে ঠিকমতো ধর্মকর্ম করতে পারছেন না। একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে এক লাখ টাকা বেতনে চাকরি পেয়েছেন। তাঁদের সংসার চালাতে কোনো কষ্ট হবে না।

খুশি না হলেও দুই পরিবারই এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিল। একপর্যায়ে তাঁরা পরিবারবিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তার আগে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে তাঁদের মা-বাবাকে জানিয়েছিলেন যে তাঁরা সৌদি আরব চলে যাচ্ছেন। কিন্তু ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার রূপনগরে পুলিশের অভিযানে মেজর জাহিদের মৃত্যুর পর দুই পরিবার জানতে পারে, সন্তানেরা তাঁদের বিভ্রান্ত করেছেন, তাঁরা বিদেশের কথা বলে গিয়েছেন জঙ্গি আস্তানায়।

জেবুন্নাহারের মা জোহরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, জাহিদের মৃত্যুর পর মেয়ের খোঁজে তাঁর বাবা উত্তরার এমন কোনো জায়গা নেই খোঁজ করেননি। কারণ, যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে তাঁরা উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে থাকতেন।

গত শনিবার আশকোনায় পুলিশের অভিযান চলার সময় জোহরাকে সেখানে নিয়ে যায় পুলিশ, যাতে মেয়েকে আত্মসমর্পণে রাজি করানো যায়। জেবুন্নাহার মায়ের ডাকে এক বছরের শিশু কোলে করে বেরিয়ে আসেন ওই জঙ্গি আস্তানা থেকে। পরদিন জোহরা বেগম ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করেন মেয়ের সঙ্গে। সঙ্গে নিয়ে যান আজিমপুরের আস্তানা থেকে উদ্ধার পাওয়া জেবুন্নাহারের মেয়েকে (৭)।

জোহরা বেগম  বলেন, ‘ছোট নাতনিটা আমার শুকায়ে গেছে। কী খাইছে, ক্যামনে ছিল কে জানে। বড়টাকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসতে খুব কষ্ট হয়েছে। সে খালি বলে আম্মু বাসায় চলো। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছি, একদিন মা আসবে।’

যার খোঁজে আশকোনায় পুলিশ অভিযান চালিয়েছিল, সেই মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা ও তৃষা মনি দম্পতিও এখন সমাজের চোখে অপরাধী।

তৃষা মনির মা নাজমা খাতুন গতকাল দুপুরে বলেন, এক বছর আগে তাঁর মেয়ে তৃষা ও জামাতা বাড়িতে এসেছিলেন। তখন তৃষা গর্ভবতী ছিলেন। তাঁরা বাড়িতে এসে তাঁদের সব ছবি পুড়িয়ে ফেলেন। বলেন, ছবি রাখা পাপ। এই পরিবর্তনে তাঁদের সন্দেহ হলেও জঙ্গির সঙ্গে জড়াতে পারে এমন ধারণা ছিল না মায়ের। তাঁরা বিদেশ চলে যাচ্ছেন বলে বাড়ি থেকে বিদায় নেন। এটাই ছিল মায়ের সঙ্গে তৃষার শেষ দেখা।