সহনশীলতাই রুখতে পারে সংহিসতা – মামুনুর রশিদ
সহনশীলতা ও সহিংসতা বিপরীতধর্মী শব্দদুটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এগুলো বেশ আলোচিত শব্দ। একটি সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে অপরটি বিশৃংখলা ও অশান্তির জন্ম দেয়। প্রতিদিনই এর সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটছে। বিভিন্নমুখী ঘটনাবলীর সঙ্গে উঠে আসছে শব্দদুটি। এর মধ্যে সহিংসতা সামাজিক ব্যাধি হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। তবে এর প্রভাব শুধু সামাজিকভাবে নয়, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও পরিলক্ষিত হয়। এর কবলে পড়ে ঝরে যাচ্ছে অজস্র প্রাণ। বিশৃংখলাও বাড়ছে সমানতালে। অপ্রত্যাশিত হলেও প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকার সংহিসতার খবর আমরা দেখতে পায়। মিডিয়াগুলো ফলাও ভাবে প্রকাশ করে সংহিসতার খবর। তবে এই খবর কী আমার দেখতে চায়। সম্ভবত সবাই এড়িয়ে যেতে চায় শব্দটিকে। সহিংসতার পরিবর্তে আমার দেখতে চায় শান্তি ও সহনশীলতার পরিবেশ বজায় থাকুক এটাই কাম্য। এতে করে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন গড়ে উঠবে। তবে এজন্য কিছু উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড অত্যাবশক।
সহিংসতার মূল কারণ হিসাবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি সহনশীলতার অভাব। আমরা পরস্পরের প্রতি সহনশীল হলে সহিংসতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। একে অপরকে ভালোবাসবো, ছোট খাটো অপরাধ ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখলে সংহিসতা আড়ালে থাকবে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বাগ্রে। সহনশীলতা বজায় রাখতে আমাদের ত্যাগও স্বীকার করতে হবে। পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসার ও সহযোগিতার সর্ম্পক দৃঢ় করতে হবে। আমরা বিভিন্ন কারণ এবং অকারণে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে হিংস্র হয়ে উঠি। এতে হানাহানি বেড়েই যায় ক্রমশই। সহিংসতাকে আমরা বিভিন্নভাবে এড়িয়ে চলতে পারি। এজন্য নিজের মানসিকতার এবং সমাজের পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যক্তি ও সামাজিকভাবে নানা ধরণের উদ্যোগ নেওয়াও আবশ্যক। বিভিন্ন কর্মসূচিও হাতে নেওয়া যেতে পারে।
সংহিসতা এড়াতে আমাদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা- বাড়াতে হবে। আজকাল সামাজিক কর্মকা- নেই বললেই চলে। সবকিছু যেন অতীত ও ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। যান্ত্রিক ও প্রযুক্তির টানে সামাজিক কর্মকা-গুলো অতলে চলে যাচ্ছে ক্রমশই। সামাজিক কর্মকাণ্ড না থাকায় লোকজন জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন হানাহানিতে। সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন অনেকে। আমাদের যুবসমাজ বিশেষ করে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুযা শিক্ষার্থীদের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে বেশি। সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হলে তাদের ভেতর থেকে হারিয়ে যাবে কুবুদ্ধি ও হানাহানির মানসিকতা।
হলি আর্টিজানে আত্নঘাতি জঙ্গি হামলায় নিহত জঙ্গিরা সবাই বয়সে তরুণ ও যুবক শ্রেণির ছিলেন। পরিবারের সদস্যদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় তাদের জঙ্গির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার যে কারণ আমরা জানতে পেরেছি, তাতে সহজে বোঝা যায় তাঁরা ছিলেন সামাজিক কর্মকা-ের বাইরে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে জড়িয়ে পড়ে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের। পরে হিংস্র হয়ে ওঠেন তাঁরা। আরও অনেকে প্রযুক্তির অব্যবহারের মাধ্যমে জঙ্গির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন সেটাও এসেছে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। এদের অধিকাংশ ছিলেন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা- থেকে অনেক দূরে।
সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দিকেও নজর দিতে হবে। সাংস্কৃতিক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষদের মাঝে প্রগতি এবং উদার চিন্তাভাবনার সৃষ্টি হবে। একজন উদার ও প্রগতি চিন্তার মানুষ কখনোই খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারেন না। এজন্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আয়োজন করা যেতে পারে সুস্থ ধারার বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। এক সময় গ্রামগঞ্জে বিভিন্ন উপলক্ষে ও দিবসে আয়োজন করা হতো বিচিত্র ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। সব শ্রেণির লোকজনের অংশ গ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো। গ্রামের মানুষগুলো নিজেদের মাতিয়ে রাখতেন অনুষ্ঠানের ভেতরে। পরস্পরের মধ্যে গড়ে তুলতেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এসবকে কেন্দ্র করে গ্রমাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংঘ ও প্রতিষ্ঠান। তবে সাংস্কৃতিক কর্মকা- ঝিমিয়ে পড়ার কারণে সংগঠনগুলো বিলিন হয়েছে অথবা রুগ্ন অবস্থায় রয়েছে। সহিংসতারোধে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কাজেই এদিকে নজর দেওয়াটা জরুরি।
বর্তমানে দেশে যেসব সংহিসতা হচ্ছে তার বেশিরভাগই সামাজিক বা পারিবারিক। তবে রাষ্ট্রীয় ভাবে যে কম হচ্ছে তা বলা যাবে না। এসব সহিংসতার সঙ্গে যারা জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন বয়সের লোকজন। তবে যুবক ও তরুণদের সংখ্যা বেশি। এদের অনেকে মাদকাসক্ত। বর্তমান সময়ে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জোড়ালো তৎপরতা শুরু করেছেন। মাদকসেবন ও বিক্রিরোধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। এটি একটি আশার দিকও বটে। এছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব সংহিসতা দেখা দেয় তা প্রতিরোধের দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে। বিভিন্ন দাবি দাওয়ার প্রেক্ষিতে আন্দোলন থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাজনীতিক দল, গোষ্ঠি, শ্রেণি-পেশার লোকজন এই ধরণের সহিংসতার জন্ম দেয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে তা সহিংস হয়ে উঠে। এসব রোধে রাষ্ট্রকেও দায়িত্ব নিতে এবং সহনশীল হতে হবে। যেসব দাবি দাওয়ার প্রেক্ষিতে আন্দোলন হয় তা সহিংসতার পর্যায়ে আসার আগেই সমাধান করতে হবে। অথবা আন্দোলন হলেও সরকারের সহনশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অযথা লাঠি চার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও বাধাপ্রধান করে উত্ত্যক্ত বা পরিবেশ উত্তপ্ত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে সরকারকে। সাম্প্রতিকালের বেশকিছু আন্দোলন দেখেছি রাষ্ট্রের সহনশীলতার অভাবে তা সহিংসতায় রুপ নিয়েছে। সবচেয়ে বড় নজির কোটা সংস্কার আন্দোলন।
সহিংসতা দেশ তথা জাতিকে পিছিয়ে এবং অশান্তির জন্ম দেয়। উন্নয়নে বাধাগ্রস্থ হয়। একটি দেশ, জাতি পিছিয়ে পড়ুক এমনটি কাম্য কোনো নাগরিক করেন না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সহিংসতাকে মোকাবেলা করতে হবে। সহনশীল হবে নিজেদের। কেন না সহনশীলতার মাধ্যমেই সহিংসতাকে মোকাবেলা করা সম্ভব।
পরিচিতিঃ সাংবাদিক, দৈনিক প্রথম আলো, বাগমারা, রাজশাহী।