আগামী ২৪ এপ্রিল সারা দেশে পবিত্র লাইলাতুল মিরাজ
অনলাইন ডেস্ক : সমগ্র সৃষ্টির ইতিহাসে ‘মিরাজ’ একটি অনন্য সাধারন ঘটনা বলে বিবেচিত। সায়্যেদুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অলৌকিক ঘটনাবলীর মধ্যে মিরাজ অন্যতম বিস্ময়কর ঘটনা। মিরাজ বিশ্বনবী (সাঃ) এর ‘সাইয়্যেদুল আম্বিয়া’ অর্থাৎ নবীকুল শিরোমণীর শ্রেষ্ঠত্বের আশ্চর্য প্রমানও বটে। এই মিরাজের মাধ্যমেই রাব্বুল আলামিন তাঁর অনন্ত করুনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিবিড়তম সান্নিধ্যের অকল্পনীয় সুযোগ দান করেন।
এ এমন এক জ্যোতির্ময় অনিন্দ সুন্দর সৌভাগ্যের দর্শন যা সমগ্র নবী রাসূল তথা মানব ইতিহাসে অন্য কোন ব্যক্তির জীবন চরিত দীপ্ত করতে পারে নি। কেবল মানুষই নয়; ফেরেস্তা ও জিন জাতিও মহান প্রভুর এতটা কাছে যেতে সমর্থ হয়নি। ফলে মহানবী (সাঃ) এর মিরাজ স্বর্ণোজ্জ্বল আভায় চির ভাস্বর হয়ে আছে এবং থাকবে বিশ্বের ইতিহাসে।
আগামী ২৪ এপ্রিল সারা দেশে পবিত্র লাইলাতুল মিরাজ পালিত হবে।
‘মিরাজ’ কি? আরবি শব্দ। সাধারন অর্থে উর্ধ্বে গমন, আরোহন, সিঁড়ি ইত্যাদি বুঝায়। ইসলামী পরিভাষায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পবিত্র মসজিদুল হারাম থেকে জেরুযালেমস্থ বায়তুল মুকাদ্দাস, সেখান থেকে উর্ধ্বে সপ্তাকাশ সফর শেষে মহান প্রভুর নিবিড়তম সান্নিধ্য লাভের বিস্ময়কর ঘটনাকে মিরাজ নামে অভিহিত করা হয়। ঐতিহাসিক এ সফরটি রাতের বেলায় ঘটেছিল। এ জন্যে এ ঘটনাটি শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ নামে সমধিক পরিচিত হয়ে আছে। ‘শব’ এবং ‘লাইলাতুল’ উভয়ের শাব্দিক অর্থ রাত।
ঐতিহাসিকদের মতে মিরাজ সংঘঠিত হয়েছিল হিজরতের এক বছর পূর্বে নববীর একাদশ সনে ২৭ শে রজব এক অনন্য বৈশিষ্ট্য রজনীতে। এ মুবারক রজনীতে বিশ্বনবী (সাঃ) তার চাচাতো বোন উম্মে হানীর গৃহে নিদ্রায় শায়িত ছিলেন। গভীর রাত। জিব্রাইল (আঃ) তার সঙ্গে মিকাইল (আঃ) কে নিয়ে সেই গৃহে পদার্পন করলেন। তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন বিদ্যুতের ন্যায় দ্রুত বেগবান একটি জীব, যার নাম বুরাক। রহমতে আলম (সাঃ)কে উঠিয়ে নিয়ে তাঁরা প্রথমে মক্কাস্থ পবিত্র হারাম শরীফে আসলেন এবং সেখানে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) নবী করিম (সাঃ) এর সীনা-চাক (বক্ষ-বিদীর্ণ) করে ইলেম ও প্রজ্ঞায় কলবকে পরিপূর্ন করে তুললেন, এরপর তাঁর স্বন্ধে ‘মুহরে নবুয়াত’ সংযোজন করা হয়। তাদের সঙ্গে আনিত সওয়ারী বুরাকটি আকারে খচ্চর হতে ছোট এবং গাধা থেকে উচু ছিল। বুরাকে সওয়ার হয়ে রহমত আলম প্রিয়নবী (সাঃ) মক্কাস্থ মসজিদুল হারাম থেকে জেরুযালেমস্থ বায়তুল মুকাদ্দাসে উপস্থিত হয়ে সেখানে অপেক্ষমান আম্বিয়া কেরামদের নামাজে ইমামতি করেন। অতঃপর আলমেআলা বা উর্ধ্ব জগতে সফরের পালা। জিবরাঈল (আঃ) সমভিব্যাহারে উর্ধ্বকাশে আরোহন শুরু করেন। সাত আসমানের প্রতিটির মধ্য দিয়ে তিনি সফর করেন। প্রত্যেক আসমানের প্রহরী ফেরেশতাগণ আগুন্তকের পরিচয় সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর উর্ধ্বারোহনে অনুমতি প্রদান করেন। সাত আসমানের প্রতিটিতেই নবী করীম (সাঃ) এর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে যে সকল আম্বিয়া কেরাম এর কথোপকথন হয় তাঁরা হলেনঃ হযরত আদম (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ), হযরত ইউসুফ (আঃ), হযরত ইদ্রীস (আঃ), হযরত হারুন (আঃ), হযরত মুসা (আঃ), হযরত ইব্রাহিম (আঃ)।
সপ্তাকাশে ‘বায়তুল মামুরে’ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়। বায়তুল মামুর কাবা শরীফের ঠিক ওপরের দিকে অবস্থিত। অতঃপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহায় জান্নাতের অনন্ত সুখ-শান্তি এবং জাহান্নামের কঠিন শাস্তির দৃশ্য অবলোকন করেন।
সিদরাতুল মুনতাহা থেকে ওপরে আরশে মুয়াল্লায় ‘রফরফ’ নামক নরম সবুজ গালিচার ন্যায় সওয়ারীতে আরোহন করে বিশালায়তন প্রাঙ্গন গালিচার ন্যায় সওয়ারীতে আরোহন করে বিশালায়তন প্রাঙ্গন পাড়ি দিয়ে আরশ ও কুরসীর কাছে উপস্থিত হন। এখানেই মহান প্রভূ আল্লাহকে তাঁর অপরূপ মহিমায়, পূর্ণ সৌন্দর্য্য ও সুসমায় সন্দর্শন লাভ করার অনির্বচনীয় গৌরব অর্জন করেন, অনিন্দ সুন্দর চিত্তে তিনি সেই রাতেই আবার পবিত্র মক্কা নগরীতে উম্মে হানীর গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সমস্ত ঘটনা অতি অল্প সময়ের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। মিরাজের তোহফা হিসেবে তাঁর উম্মতের জন্য নিয়ে আসেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।
মিরাজ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বর্ননা পাওয়া যায়। সুরা বনী ইসরাইলের প্রথম আয়াতে উল্লেখ আছে; ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে ভ্রমন করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়। যার পরিবেশ তিনি করে ছিলেন বরকতময়, তাঁকে (আল্লাহর) নিদর্শন দেখানোর জন্য। তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা’। সুরা আন নাজম এর ৭-৯ আয়াতে মিরাজ সম্পর্কে আরও বর্ণানা পাওয়া যায় ‘আর তিনি ছিলেন দিগন্ত পরিধির উর্ধ্বতম দেশে। তিনি কাছে আসছিলেন। কিন্তু আরও নৈকট্য লাভে ইচ্ছুক হইলেন। ফলে ব্যবধান রহিল মাত্র দুই ধনুক পরিমানের।”
পবিত্র কুরআন ছাড়াও সহীহ বুখারী ও মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে মিরাজ এর বিবরন বিবৃত হয়েছে। ২২ জন সাহাবী ও ৪ জন মহিলা সাহাবী মিরাজ সম্বন্ধে রিওয়ায়েত করছেন বলে প্রমান পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মিরাজঃ বিজ্ঞানের আলোকে মিরাজ বলে অনেকে মন্তব্য করে থাকেন। যা সঠিক নয়। কেননা মিরাজ সংঘঠিত হয়েছে বহু আগে এবং মিরাজ এর আলৌকিক, বিস্ময়কর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বিজ্ঞানের নানা মুখি গবেষণা এবং তা বাস্তবতার নিরিখে প্রমানের জন্য বিজ্ঞানীরা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্ণিত আছে, মিরাজে নবী করিম (সাঃ) তিন লক্ষ বছরের পথ পরিভ্রমন করেছিলেন এবং তাতে জাগতিক সাতাশ বছর সমপরিমান সময় ব্যয়িত হয়েছিল অথচ মহানবী (সাঃ) ক্ষণিকের মধ্যে সপ্তাকাশ ভ্রমন, বেহেশত ও দোযখ প্রত্যক্ষ ও আল্লাহর দীদার লাভ করেন পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন।
মিরাজে সংগঠিত ঘটনাবলী সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক, জৌতির্বিদ, দার্শনিক অবস্থান এই বিস্ময়কর ঘটনা কোন বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতে চায় নি। কেননা এ দুঃসাধ্য ঘটনা কি করে সম্ভব ? কিন্তু যখন রকেট আবিস্কার হল তখন মানুষের ভুল ভাঙতে শুরু করল। যদি একটি রকেট দশ হাজার ফুট উর্ধ্বে ওঠে ঘন্টায় প্রায় চার হাজার পাঁচশ মাইল অতিক্রম করতে পারে তাহলে ‘বুরাক’ নামক বাহনে সম্ভব হবে না কেন ? ‘বুরাক’ শব্দটি আরবী। যার অর্থ ‘বিদ্যুৎ’। অর্থাৎ বুরাক নামক আল্লাহর প্রদত্ত বাহনটির গতি ছিল বিদ্যুতের গতি বেগের চেয়েও বেশি আর বিদ্যুতের প্রতি সেকেন্ড গতিবেগ হল এক লাখ পঁচিশ হাজার মাইল। বিদ্যুৎ থেকে উৎপাদিত আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ ছিয়াশি হাজার মাইল। অর্থাৎ তিন লাখ কিলোমিটার যা সমগ্র পৃথিবীতে সাত বার পরিভ্রমন এর সময় বুঝায়। বুরাকের চেয়েও গতি সম্পন্ন দ্রুততম যান ‘রফরফ’ মিরাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। তা হলে প্রশ্ন হতে পারে এই রফরফের গতি বেগ কত ছিল ? মানুষের তৈরি রকেট, বিদ্যুতের আলোর গতি যদি এতটা দ্রুততর হয়, তাহলে মহান শক্তিধর প্রভূর সৃষ্ট বুরাক, রফরফ বা যান বাহনের গতি কতটা ক্ষিপ্রতর ছিল তা মানুষের কল্পনা করাও দুঃসাধ্য ব্যাপার।