শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

‘উদ্যোক্তা’ কোটায় ‘চাকরির’ দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি!

SONALISOMOY.COM
ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৭
news-image

অনলাইন ডেস্ক:
খবরটি ছাপা হয়েছে প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে; যদিও সেভাবে সবার নজরে হয়তো আসেনি। তবে খবরটি আর দশটি ‘আমরণ অনশনের’ নয়। একটু অভিনবই বটে। সপ্তাহ দুয়েক আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হয় দেশের তৃণমূল ডিজিটাল কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের এক বড় অংশ। ‘চাকরির’ দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করে তাঁরা ইউনিয়ন পরিষদে হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ-প্রক্রিয়া বাতিলের দাবি তুলেছেন। তাঁদের দাবি, ওই পদে তাঁদের নিয়োগ দিয়ে জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত করতে হবে।

উল্লেখ্য, ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত দেশের প্রায় পাঁচ হাজার ডিজিটাল সেন্টারের প্রতিটিতে একজন নারী ও একজন পুরুষ হিসেবে প্রায় ১০ হাজার উদ্যোক্তা রয়েছেন। সরকারের উদ্যোগে প্রতিটি কেন্দ্রে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ডিজিটাল ক্যামেরা, ওয়েবক্যাম, ইন্টারনেট মডেম এবং কোথাও কোথাও সোলার প্যানেল সরবরাহ করা হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। পাশাপাশি উদ্যোক্তারা নিজেরা পছন্দমতো সরঞ্জামাদি কিনেছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা হয়। বছরখানেক আগে ঢাকায় প্যারেড গ্রাউন্ডে তাঁদের একটি কেন্দ্রীয় সমাবেশও হয়েছে। সরকারি হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ লাখ সেবাসহ এখন পর্যন্ত ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে প্রায় ২১ কোটি ৬০ লাখ সেবা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, উদ্যোক্তারা কেন্দ্রের মাধ্যমে তথ্যসেবা দিয়ে আয় করবেন, সরকার তাঁদের কোনো ধরনের বেতন-ভাতা দেবে না।

উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সরকারি সেবা তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার এই উদ্যোগটি বিশ্বব্যাপী প্রশংসিতও হয়েছে। তবে এ সাফল্যের মধ্যেও কিছু চ্যালেঞ্জও দেখা যায় এ-সংক্রান্ত কিছু গবেষণায়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং, ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে স্থানের অভাব, প্রচারের অভাব, কিছু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অসহযোগিতা, নারী উদ্যোক্তাদের অভাব কিংবা ঝরে পড়া এবং ইন্টারনেটের ধীর গতি। কিন্তু গতানুগতিক ধারার এসব চ্যালেঞ্জ ছাপিয়ে এমন একটি চ্যালেঞ্জ সামনে উঠে এসেছে, যার প্রতিফলন হলো শহীদ মিনারের সমাবেশ। এটি হলো উদ্যোক্তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে থাকার অনাগ্রহ!

দেশের বিভিন্ন ডিজিটাল কেন্দ্রের পুরুষ ও নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় কথা বলে দেখা গেছে, তাঁরা আশায় আশায় আছেন, কোনো এক সময় সরকারের এই উদ্যোগের সঙ্গে যেসব উদ্যোক্তা আছেন, তাঁদের সরকারের কর্মচারী হিসেবে আত্তীকরণ করা হবে। আর সে জন্য তাঁরা ছয় বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে শুধু দায়িত্ব পালনই করেননি; বরং ইউনিয়ন পরিষদের দাপ্তরিক কাজ বিনা পারিশ্রমিকে করেছেন। কোনো কোনো ইউনিয়নে দেখা গেছে, সচিবের অনুপস্থিতিতে উদ্যোক্তা পরিচালক সচিবের পক্ষ হয়ে কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করছেন।

এখন ইউনিয়ন পরিষদে সচিবের সহায়তাকারী হিসেবে হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগের উদ্যোগ তাঁদের সেই স্বপ্নে পানি ঢেলে দেওয়ার শামিল। তাঁদের বক্তব্য, এতে ১০ হাজার ইউডিসি সেন্টারের পরিচালকেরা বেকার হয়ে যাবেন। কাজেই তাঁদেরই এই চাকরি দেওয়া হোক।

উদ্যোক্তা কোটায় চাকরি পাওয়ার এই অভিনব আবদারের পেছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখা যাক। গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্যোক্তারা একধরনের আর্থিক অনিশ্চয়তায় থাকেন। কোনো মাসে ভালো আয় হয় আবার কোনো মাসে তেমন কোনো আয় হয় না। ‘আত্তীকরণ করে সরকারি কর্মচারী করা হলে তাঁদের আয়ের অনিশ্চয়তা কেটে যাবে’ বলে তাঁরা মনে করেন। নারী উদ্যোক্তাদের অনেকে বিয়ের পর ঝরে পড়েন। বাকিরা এ আশাতেই আসেন যে হয়তো কোনো একদিন এটা সরকারি চাকরিতে রূপান্তরিত হবে!

এ থেকে পরিষ্কার, প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার উদ্যোক্তা সৃষ্টির উদ্যোগ নিলেও উদ্যোক্তাদের একটা অংশ প্রথম থেকেই সরকারি মাসকাবারি চাকুরে হওয়ার ইচ্ছে নিয়েই এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। অর্থাৎ এই উদ্যোগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সঠিকভাবে অংশগ্রহণকারীদের কাছে পৌঁছায়নি। আর সে কারণেই এই বিশাল কর্মোদ্যোগ উদ্যোক্তাদের মনমানসিকতায় কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে।

পাশাপাশি এর জন্য কেন্দ্র পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের কোনো আর্থিক দায় না থাকার বিষয়টিও হয়তো দায়ী। সরকার প্রতিটি কেন্দ্র গড়ে প্রায় তিন লাখ টাকার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিয়েছে। সাধারণ একজন উদ্যোক্তা কিন্তু তেমন কোনো সুযোগ পান না। তাঁকে তাঁর উদ্যোগ শুরু করার মূলধনটাও জোগাড় করতে হয়। বোঝা যাচ্ছে, ডিজিটাল কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশ এই উদ্যোগের মূল সুরটিই ধরতে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা ধরতেই চায়নি। হয়তো সরকারের এই বদান্য এবং ঔদার্য সবাইকে একটি ভুল বার্তা দিয়েছে। উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীদের যে কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ আর বুদ্ধির পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ নিতে হয়, তার তুলনায় সরকারি চাকুরে হয়ে মাস শেষে নিশ্চিত বেতন সেটা যতই অল্প হোক না কেন অনেক বেশি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত এই উদ্যোগ এখন একটি বড় ক্রান্তিকাল পার করছে।

উদ্যোক্তা হওয়া যে কত কঠিন একটা যাত্রা, সেটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তাদের প্রথম জীবনের গল্পই প্রমাণ। আর বাংলাদেশের মতো একটা দেশে সেটা আরও কঠিন, যেখানে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন বাঁধা পড়ে আছে পড়াশোনা শেষে একটা চাকরি পাওয়ার মধ্যে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশ তরুণ এবং নতুন গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি ১০ জনে প্রায় ১০ জনই চান একটি চাকরি জোগাড় করতে। এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে যোগ হয় এবং মাত্র অর্ধেকের ব্যবস্থা হয় স্থানীয় ও বিদেশি চাকরির বাজারে। বাকিদের জন্য চাকরি সোনার হরিণই থেকে যায়।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হলো তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তাসুলভ মনোভাব গড়ে তুলে তাঁদের আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করা। চাকরি না করে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহী করে তোলা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে এমন একটি সুর শহুরে তরুণদের আকৃষ্ট করছে। ফেসবুকভিত্তিক পেজ ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ এমন একটি উদ্যোগ। পাশাপাশি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগও প্রশংসার দাবি রাখে। তবে দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার বড় সংস্কৃতি গড়ে তুলছে তরুণদের মধ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার। অনেক তরুণই এখন প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে নিজের মতো করে কর্মসংস্থানে উদ্যোগী হচ্ছেন এবং সরকারের ডিজিটাল কেন্দ্রের উদ্যোগ তৃণমূল পর্যায়ে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তৈরি করেছে।

তাই ডিজিটাল কেন্দ্র উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশের আন্দোলনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এই ‘উদ্যোক্তা কোটায় চাকরি’ চাওয়ার এ পরিস্থিতিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত হবে পুরো বিষয়টি আবারও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা এবং বাস্তবতার নিরিখে কর্মসূচিটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করার কৌশল শনাক্ত করার চেষ্টা করা। সুত্র, প্রথম আলো